Sunday, July 6, 2025
Google search engine
Homeটপ 10 নিউসদেশলাখ টাকার কোলাপুরি চপ্পলে আইনের কব্জায় ইতালি সংস্থা

লাখ টাকার কোলাপুরি চপ্পলে আইনের কব্জায় ইতালি সংস্থা

Italian company in legal trouble over Kolhapuri slippers worth lakhs of rupees : সম্প্রতি সোশাল মিডিয়া থেকে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শো— সর্বত্র আলোড়ন ফেলে দিয়েছে একটি জুতো! শুনতে অবাক লাগলেও, এই জুতোর দাম ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা! আর এই দামের ‘কোলাপুরী চপ্পল’ বানিয়েছে ইতালির এক নামী ফ্যাশন ব্র্যান্ড। সমস্যা হলো, তারা এই ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় শিল্পের কোনও স্বীকৃতি দেয়নি। হ্যাঁ, আপনি ঠিক পড়েছেন— মহারাষ্ট্রের কোলাপুর জেলার কারিগরদের হাতের তৈরি সেই কোলাপুরী চপ্পল, যেটি ২০১৯ সালে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (GI) ট্যাগও পেয়েছে, সেটিকেই কপি-পেস্ট করে নিজেদের ডিজাইন বলে চালিয়ে দিয়েছে ওই ইতালীয় ফ্যাশন হাউস। আর এ নিয়েই সোশাল মিডিয়ায় উঠেছে প্রবল ক্ষোভ, প্রতিবাদ, এমনকি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে বিষয়টি। পুরো ঘটনাটাই যেন এক রকমের চলন্ত সিনেমা— যেখানে ভারতীয় কারিগরদের ন্যায্য অধিকার এবং সম্মানের প্রশ্ন উঠেছে।

ঘটনার সূত্রপাত যখন ইতালির ওই ফ্যাশন সংস্থা এক আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শো-তে তাদের নতুন কালেকশন উপস্থাপন করে। সেই র‍্যাম্পে উঠে আসে ঝকঝকে, চকচকে একজোড়া কোলাপুরী চপ্পল— যার দাম হাঁকা হয়েছে ১.২ লক্ষ টাকা! দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসা কুড়োলেও ভারতীয় নেটিজেনদের চোখে পড়ে যায় চপ্পলের পরিচিত ডিজাইন। মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় ছবি, আর সোশাল মিডিয়ায় শুরু হয় প্রশ্নবাণ— “এটা তো আমাদের কোলাপুরী চপ্পল! স্বীকৃতি কোথায়?” এরপর ক্রমেই তীব্র হয় প্রতিবাদ। বিভিন্ন হ্যান্ডলুম ও হস্তশিল্প সমর্থক সংগঠন, সংস্কৃতি প্রেমীরা এবং সমাজকর্মীরা এই ইস্যুতে মুখ খোলেন। টুইটারে ট্রেন্ড হয় #KolhapuriJustice এবং #CreditOurArtisans।

history+of+kolhapuri

এই পরিপ্রেক্ষিতে মহারাষ্ট্রের এক নামী আইনজীবী গণেশ হিংমিরে বম্বে হাই কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা (PIL) দায়ের করেন। তাঁর বক্তব্য, “যে শিল্প ভারতের ঐতিহ্য বহন করে, সেই শিল্পকেই চুরি করে বিদেশি সংস্থা নিজেদের নামে চালাচ্ছে। এটা শুধু শিল্প চুরির প্রশ্ন নয়, এটা আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের কারিগরদের জীবনের রুটি-রুজির প্রশ্ন।” মামলায় দাবি করা হয়েছে, কোলাপুরী চপ্পল যে ভারতীয় অনুপ্রেরণায় তৈরি, তা স্বীকার করেও সংস্থাটি ‘দায়সারা’ ভাষায় বলেছে, ভারতীয় কাজ থেকে তারা ‘inspired’। কিন্তু সেটিকে তাঁরা ঠিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি বা কোনও কারিগর বা সংস্থার নাম প্রকাশ করেনি। তাছাড়া, যে পণ্যের দাম লাখ টাকা— তার জন্য ভারতীয় কারিগরদের এক টাকাও দেওয়া হয়নি। এইসব কারণেই ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন হিংমিরে— যা কেবল টাকার প্রশ্ন নয়, বরং সম্মান এবং প্রাপ্য মর্যাদার প্রতীক।

এই সংক্রান্তভাবে কোলাপুরের স্থানীয় কারিগর শরৎ কাম্বলে বলেন, “আমি আর আমার বাবা-মা তিন পুরুষ ধরে এই চপ্পল বানাচ্ছি। আমরা চিনি গন্ধে বুঝে যাই কোন চামড়া ভালো, কোন ডিজাইনে আরাম হবে। আজ সেটাই যদি অন্য কেউ কপি করে কোটি টাকা কামায় আর আমাদের নামটুকু না নেয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায়?” আরেকজন প্রবীণ কারিগর রফিক শেখ বলেন, “ওই কোম্পানিকে শুধু দুঃখপ্রকাশ করলেই হবে না। আমাদের কাজের ন্যায্য মূল্য ও স্বীকৃতি দুইই দিতে হবে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘটনা আন্তর্জাতিক হস্তশিল্প এবং ডিজাইন সংক্রান্ত নৈতিকতার বড় উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। প্রোডাক্টের সোর্স বা উৎস দেশ উল্লেখ করা এখন ক্রেতাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ইস্যুটি শুধু ভারত বা ইতালির মধ্যকার কোন কপি কাণ্ড নয়, বরং গ্লোবাল স্কেলে উন্নয়নশীল দেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্প কিভাবে ধনী দেশের কর্পোরেটের দ্বারা শোষিত হচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছে। অনেকেই এই ঘটনাকে ২০১৭ সালে ক্যানাডার এক কোম্পানির ‘বিন্দি’ ডিজাইন করে বিক্রি করার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করছেন, যেখানে ভারতীয় নারীদের ঐতিহ্যকে বিদেশি ফ্যাশন ট্রেন্ডে রূপান্তর করা হয়েছিল কোনো সম্মান ছাড়াই।

এছাড়া, এটি GI ট্যাগ থাকা সত্ত্বেও যদি কোনও ভারতীয় শিল্পকে বিদেশি সংস্থা কপি করতে পারে, তবে GI আইনগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ২০১৯ সালে যখন কোলাপুরী চপ্পল GI তকমা পায়, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এটি কারিগরদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করবে। কিন্তু বাস্তবে যদি এইরকম সংস্থাগুলি GI ট্যাগকে পাশ কাটিয়ে যায়, তাহলে সাধারণ কারিগরের কী লাভ?

সাংসদ সুভাষ দেশাই এই প্রসঙ্গে বলেন, “এই ঘটনা মহারাষ্ট্র তথা ভারতের পাদুকা শিল্পের জন্য অপমানজনক। আমরা চাই, ভারত সরকার এই বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ নিক এবং আন্তর্জাতিক স্তরে এই ধরণের শিল্প-চুরি রুখতে উদ্যোগ নিক।” ইতিমধ্যে বস্ত্র ও হস্তশিল্প মন্ত্রকের পক্ষ থেকেও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে সূত্রে খবর।

এই ঘটনার ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে অনেকেই আশাবাদী যে এবার অন্তত ভারতীয় কারিগরদের কাজের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলবে এবং বিদেশি ব্র্যান্ডগুলি আরও সচেতন হবে। তবে কারিগরদের বক্তব্য একটাই— “আমাদের নামটুকু দিক, সম্মান দিক, আমরা টাকা চাই না, চাই আমাদের পরিচয় রক্ষা হোক।”

এই ঘটনার পরে একটি ইতালিয়ান ডিজাইনার ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, “Yes, we drew inspiration from Indian footwear craftsmanship, and we truly admire their legacy.” কিন্তু তার সাথে কোনও ভারতীয় শিল্পী বা সংস্থার নাম উল্লেখ করেননি। এইভাবেই যেন আধা-স্বীকারোক্তির পথ নিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা চলছে।

শেষ কথা, এই ঘটনা শুধু একটি চপ্পলের কাহিনি নয়, এটি ভারতের মাটি থেকে জন্ম নেওয়া এক ঐতিহ্যের, যা রক্ত-মেহনত-মূল্যবোধ আর দক্ষতায় তৈরি। আর যদি সেই ঐতিহ্যই চুরি হয়ে যায়, তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমাদের সংস্কৃতি? সেদিকেই নজর রাখছে ‘খবর বাংলা’। আমাদের চোখ, আমাদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠুক এই কারিগরদের সঙ্গী।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments