Israeli attacks on Gaza journalists;গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিসে নাসের হাসপাতালের পাশে একটা ছোট্ট তাবু ছিল সাংবাদিকদের জন্য, সেখানে বসে তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতা, নিরীহ মানুষের কান্না, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া জীবনের গল্প তুলে ধরতেন গোটা পৃথিবীর সামনে, আর ঠিক সেই সত্যের তাবুতেই ৭ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে আছড়ে পড়ল ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা। রাত তখন গভীর, আকাশে গোলা-বারুদের গন্ধ, আর মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই তাবুর ছিন্নভিন্ন অংশ। হামলায় প্রাণ হারালেন এক সাংবাদিক, গুরুতর আহত আরও ৯ জন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। স্থানীয় মানুষজন অন্ধকারে পানি বালতি হাতে আগুন নেভাতে ছুটে আসেন, দমকল তো দূরের কথা, আশেপাশে কোনও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই—তবু গাজার মানুষ হার মানেন না, তাঁরা জানেন, এই আগুন নিভলেই ফের দাঁড়াতে হবে। এই হামলার ভিডিও এবং খবর সামনে আসতেই বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিউর ফ্রাঁসেস্কা আলবানিজ সরাসরি ইসরায়েলকে গাজায় নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে “গণহত্যা” চালানোর জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন, “এটি শুধুমাত্র যুদ্ধ নয়, এটি একটি পরিকল্পিত ধ্বংস। সংবাদকর্মীদের নিশানা করার অর্থ, সত্যকে ধ্বংস করার চেষ্টা।” ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে বলেন, “ইসরায়েলি বাহিনী যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে, এবং যারা এই যুদ্ধের কথা বিশ্বের সামনে তুলে ধরছে, তাদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করছে।”

এই তাবুতে কাজ করতেন বহু সাহসী সাংবাদিক, তাঁদের একজন, আল-জাজিরার ফটোগ্রাফার ইয়াহিয়া সাইদ, হামলার পরে বলেন, “আমরা জানি, এখানে থাকাটা মানেই মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিদিন দেখা করা, কিন্তু আমাদের পেছনে সরে গেলে বিশ্ব জানবে না গাজায় কী ঘটছে।” তাঁর কণ্ঠে একটুও আতঙ্ক নেই, বরং আছে একটা দায়বদ্ধতা, সত্য তুলে ধরার লড়াইয়ে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত থেকে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প। আহতদের মধ্যে রয়েছেন নারী সাংবাদিক লায়লা হামাদ, যিনি চোখে মুখে ব্যান্ডেজ বেঁধেও বলছেন, “আমাদের থামানো যাবে না, আমরা গাজার মানুষের হয়ে কথা বলতেই থাকবো।”
গাজায় চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। তাঁদের নিরাপত্তা নেই, নেই আধুনিক সরঞ্জাম, এমনকি তাঁদের জীবন বাঁচানোর কোনও গ্যারান্টি নেই। তবু তাঁরা দিনের পর দিন মাঠে থাকেন, ধ্বংসস্তূপের পাশে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, যাতে একটাও ছবি না মিস হয়, যাতে একটা কান্নার শব্দও পৌঁছায় মানুষের কানে। ৭ এপ্রিলের হামলায় নিহত হওয়া সাংবাদিকের নাম ছিল রাশিদ আহমেদ, তিনি স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যমে কাজ করতেন, পরিবারে মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর এক সহকর্মী বলেন, “রাশিদ সব সময় বলত, যদি আমার মৃত্যুর ছবি কেউ তোলে, তবে সেটাই হোক আমার শেষ রিপোর্ট।” শুনতে গা শিউরে ওঠে, কিন্তু এই কথাই বোঝায় গাজার সাংবাদিকদের মনের জোর কতটা।
ইসরায়েলি সেনা বাহিনীর এই হামলার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। যেসব তাবুতে ‘PRESS’ লেখা ছিল স্পষ্টভাবে, সেখানেই হামলা হওয়ার মানে কি এই নয় যে পরিকল্পিতভাবে সংবাদকর্মীদের নিশানা করা হয়েছে? আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “এই ধরনের হামলা যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে। সাংবাদিকদের রক্ষা করা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক।” যদিও ইসরায়েল বরাবরের মতো এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং বলেছে, ওই তাবুর আশপাশে “সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ” চলছিল। কিন্তু প্রশ্ন হল, সেই কার্যকলাপের প্রমাণ কোথায়? গাজার সাংবাদিকদের কথায়, “আমরা শুধু কাগজে-কলমে কাজ করি, গোলা-বারুদের মধ্যে দিয়ে নয়, আমাদের সঙ্গে যদি ভুল হতো তবে একবার সতর্ক করা যেত, কিন্তু এখানে তো প্রাণটাই কেড়ে নেওয়া হল।”
এই ঘটনার প্রভাব শুধু গাজার সাংবাদিকদের মধ্যে নয়, গোটা মিডিয়া দুনিয়ার উপর পড়েছে। ইজিপ্ট, তুর্কি, কাতার, এমনকি জার্মানি এবং ব্রিটেন থেকেও সাংবাদিক সংগঠনগুলি একত্রে প্রতিবাদ জানিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এটা শুধু গাজা নয়, গোটা সাংবাদিকতা জগতের উপর একটা বার্তা—যেখানে সত্য বললে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

গাজার সাধারণ মানুষের জীবন এই যুদ্ধের মাঝখানে এমনিতেই তছনছ। প্রতিদিন তাঁরা খাবার, পানি, ওষুধ—এসব ছাড়াও বাঁচার আশায় দিন কাটান। কিন্তু তাঁদের সত্যি জানার একমাত্র ভরসা এই সাহসী সংবাদকর্মীরা। আর সেই সত্য যদি বুলেট আর বোমার সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে, তবে গোটা বিশ্ব অন্ধকারে ডুবে যাবে। সংবাদপত্রের কাজ শুধুই খবর লেখা নয়, তার কাজ ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া, চোখের দেখা রিপোর্ট করে বলা—“হ্যাঁ, এটা ঘটেছে।” আর গাজার সাংবাদিকরা সেই কাজটাকেই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে করে চলেছেন, যেটা পৃথিবীর অনেক বড় বড় গণমাধ্যম আজও করতে পারেনি।
এই হামলার ভবিষ্যৎ প্রভাব আরও গভীর হতে পারে। গাজার সাংবাদিকদের মনোবল দুর্বল না হলেও, পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলি যদি নিরাপত্তার অভাবে সেখান থেকে কর্মী সরিয়ে নেয়, তাহলে গাজার নিরীহ মানুষের কান্না আর কেউ শুনবে না। তাই আজ বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষের উচিত একজোট হয়ে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, যেন আর কোনও রাশিদ, আর কোনও লায়লা এমন ভাবে প্রাণ না হারায় সত্যের খাতিরে।