Saturday, May 24, 2025
Google search engine
Homeটপ 10 নিউসদেশহার্ভার্ড নিয়ে চিন্তায় ভারতীয় পড়ুয়ারা

হার্ভার্ড নিয়ে চিন্তায় ভারতীয় পড়ুয়ারা

Indian students worried about Harvard : ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে যেন মাথায় বাজ পড়েছে ভারতের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের স্বপ্নের আকাশে। যারা দিনরাত পরিশ্রম করে, হাজারো প্রতিযোগিতা পেরিয়ে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড-এ পড়াশোনা করতে পৌঁছেছিল, তাদের কাছে এই খবর এক দুঃস্বপ্নের মতো। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সচিব ক্রিস্টি নোয়েম প্রকাশ্যে এক্স (প্রাক্তন টুইটার) হ্যান্ডেলে জানিয়েছেন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে “হিংসায় মদত দেওয়া, ইহুদি বিদ্বেষ ছড়ানো এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ” হচ্ছে। এই গুরুতর অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশাসন হার্ভার্ডের বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি বন্ধ করে দিয়েছে, এমনকি স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামও বাতিল করেছে। এই সিদ্ধান্ত কার্যত এক ঝটকায় ৬৮০০ বিদেশি পড়ুয়ার ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে, যার মধ্যে ৭৮৮ জন ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে।

এই খবরে ভারতের শিক্ষা মহল থেকে শুরু করে, ছাত্রসমাজ, অভিভাবক, এমনকি শিক্ষা-সংক্রান্ত এজেন্সিগুলির মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের একাধিক অভিভাবক, যারা সন্তানদের বিদেশে পড়ানোর জন্য ঋণ নিয়ে, সঞ্চয় ভেঙে পাঠিয়েছিলেন, তাঁদের এখন বুকের মধ্যে চাপা যন্ত্রণা। কলকাতার নিউ আলিপুরের বাসিন্দা অরুণাভ ঘোষ, যার মেয়ে ঋদ্ধিমা হার্ভার্ডের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, কাঁপা গলায় বলেন, “মেয়ে জীবনের সবটুকু উজাড় করে এই জায়গায় পৌঁছেছিল, আর এখন বলছে ফিরে আসতে হবে? ওর কেরিয়ার, স্বপ্ন সব ভেঙে যাচ্ছে। এভাবে তো চলতে পারে না।”

1 2502072203

হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এক কঠোর বিবৃতি জারি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া গোল্ডিন জানিয়েছেন, “এটি একেবারে রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ। প্রশাসন আমাদের সাংবিধানিক অধিকার, একাডেমিক স্বাধীনতাকে সম্মান করেনি। আমরা এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছি।” ইতিমধ্যেই হার্ভার্ড একটি লিগ্যাল চ্যালেঞ্জ দায়ের করেছে এবং দাবি করছে, প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে।

ভারতীয় শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে, কারণ ভারত থেকে প্রতিবছর প্রায় ২০০০ শিক্ষার্থী হার্ভার্ডসহ যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যায়। শুধুমাত্র হার্ভার্ডেই বর্তমানে ৭৮৮ জন ভারতীয় শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা মূলত ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট, লিবারেল আর্টস, মেডিকেল এবং গবেষণার মতো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছে। এদের মধ্যে প্রিয়াঙ্কা শর্মা, যিনি পিএইচডি করছেন বায়োটেকনোলজি নিয়ে, বলেন, “আমরা তো শুধুমাত্র পড়াশোনার জন্য এসেছি, কোনো রাজনীতি করতে আসিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমাদের পড়াশোনা, আমাদের ভবিষ্যৎ সবকিছু অনিশ্চিত হয়ে গেল। দিনরাত ঘুম আসে না। পরিবারও চিন্তায় ভুগছে।”

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সূত্রের খবর, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি কূটনৈতিক বার্তা পাঠানো হয়েছে, যাতে ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তা এবং শিক্ষা সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখার আবেদন করা হয়। এক সিনিয়র সরকারি আধিকারিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ভারত সরকারের কাছে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি এবং যেকোনো প্রয়োজনে দ্রুত পদক্ষেপ নেব।”

এই ঘটনায় ভারতের শিক্ষাবিদদের মধ্যে ও শিক্ষা সংস্থা ও কোচিং ইন্ডাস্ট্রির মধ্যেও এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়েছে। একটি বিখ্যাত এডুকেশন কনসালটেন্সি সংস্থার কর্ণধার সম্রাট বসু বলেন, “প্রতি বছর হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী আমাদের কাছে আসে হার্ভার্ড ও অন্যান্য শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। এই সিদ্ধান্ত তাদের জন্য একেবারে মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার মতো। এটা শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, আমাদের দেশের মেধা ও প্রতিভার জন্যও এক বিশাল ক্ষতি।”

অন্যদিকে, এই ঘটনার পর হার্ভার্ডের বেশ কিছু প্রফেসর, শিক্ষা আন্দোলনকারী এবং মানবাধিকার কর্মীরা এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন। হার্ভার্ডের একজন অধ্যাপক মাইকেল ব্রাউন বলেন, “শিক্ষা কখনোই রাজনৈতিক প্রতিশোধের হাতিয়ার হতে পারে না। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা, গবেষণা, উন্নয়ন—সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া মানে এক প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা।” মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-ও এই সিদ্ধান্তকে “বর্ণবিদ্বেষী এবং শিক্ষাবিরোধী” বলে অভিহিত করেছে।

এই ঘটনার প্রভাব শুধু হার্ভার্ডে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর ছায়া পড়তে পারে ভারত-আমেরিকা শিক্ষাগত সম্পর্কের উপরেও। এক বিশ্লেষকের মতে, “যদি এমন সিদ্ধান্ত চলতে থাকে, তাহলে আগামী দিনে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের জন্য আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথ আরও কঠিন হয়ে যাবে। এবং এতে ভারতীয় মেধাবী শিক্ষার্থীদের ইউরোপ, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বাড়বে।”

তবে এই পরিস্থিতি এখনও চূড়ান্ত নয়। আদালতের রায়, প্রশাসনিক আলোচনার ফলাফলের উপরেই নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ। তবে আপাতত ভারতীয় পড়ুয়াদের হৃদয়ে ভয়, দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তা—এই তিনটি শব্দই রাজ করছে। কলকাতার এক শিক্ষার্থী তনয়া সরকার বলেন, “আমার স্বপ্ন ছিল হার্ভার্ডে পড়ে দেশে ফিরে গিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ করার। এখন মনে হচ্ছে, সবকিছু থমকে গেল। তবে আমরা আশা ছাড়ছি না, লড়াই চলবেই।”

এই ঘটনার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচন, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতি, এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ—সব মিলিয়ে এমন সিদ্ধান্ত এক ধরনের ভোটার-লোভী পদক্ষেপ, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এক প্রজন্মের স্বপ্ন এভাবে ধ্বংস হওয়া কি কোনো সভ্য দেশের শিক্ষানীতির পরিচয় হতে পারে?

সব মিলিয়ে হার্ভার্ড নিয়ে চিন্তায় শুধু ভারতীয় পড়ুয়ারা নয়, গোটা ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা, পরিবার, শিক্ষক সমাজ এবং শিক্ষা অনুরাগী মানুষজনের মধ্যেও দুশ্চিন্তার মেঘ। এখন শুধু একটাই প্রার্থনা—এই কালো মেঘ কেটে যাক, শিক্ষার আকাশ আবার উজ্জ্বল হোক।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments