India seeks World Bank loan for Chandrabhaga dam : চন্দ্রভাগা নদীর শান্ত জলে এখন চলছে বড়সড় পরিবর্তনের ঢেউ। জম্মু ও কাশ্মীরের কিশতওয়ার জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে সেই নদীর বুকে তৈরি হচ্ছে বিশাল এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প—যার নাম কোয়ার বাঁধ। এই প্রকল্প শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন বা উন্নয়নের জন্য নয়, বরং ভারতের কূটনীতি, প্রতিবেশী সম্পর্ক এবং স্থানীয় মানুষের জীবনধারায়ও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে। ইতিমধ্যেই ভারত সরকার এই বাঁধ তৈরির জন্য বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে প্রায় ৩১১৯ কোটি টাকার ঋণ চেয়েছে, যেখানে পুরো প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৪৫২৬ কোটি টাকা। ৫৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন এই বাঁধটি নির্মিত হলে এটি জম্মু ও কাশ্মীরের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটাবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০২২ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে এই প্রকল্পের শিলান্যাস করেন এবং জানানো হয় যে ২০২৭ সালের মধ্যে এই কাজ সম্পূর্ণ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। বাঁধ নির্মাণে ব্যবহৃত হবে গ্রিনফিল্ড জলাধার, যার মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ ও পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকবে এবং পাহাড়ি অঞ্চলে শিল্পায়নের এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে যাবে। তবে ভারতের এই উন্নয়নমূলক পদক্ষেপকে সহজভাবে নিচ্ছে না পাকিস্তান। চন্দ্রভাগা নদী, যা পরবর্তীতে চেনাব নামে পরিচিত, তা সিন্ধু নদীর অন্যতম প্রধান উপনদী এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের বহু কৃষি জমি এই নদীর জলেই সেচ পায়। তাই এই বাঁধ তৈরি হলে পাকিস্তানে জলের প্রবাহ কমে যেতে পারে—এই আশঙ্কায় ইতিমধ্যেই কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়েছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তান দাবি করেছে, ভারতের এই পদক্ষেপ ১৯৬০ সালের সিন্ধু জলচুক্তি লঙ্ঘন করতে পারে।
যদিও ভারত সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, চুক্তির কোনো ধারা লঙ্ঘন করা হয়নি, বরং পাকিস্তান বারবার এই চুক্তির অপব্যবহার করে ভারতের উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা সৃষ্টি করছে। গত বছর ভারত সিন্ধু চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি স্থগিতাদেশ জারি করে, যার জেরে দুই দেশের সম্পর্ক আরও জটিল আকার নিচ্ছে। জম্মু ও কাশ্মীরের স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ এই প্রকল্পকে স্বাগত জানিয়ে জানিয়েছেন যে, “এই বাঁধ হলে আমরা বিদ্যুৎ পাবো, কাজের সুযোগ বাড়বে, আর জলের ব্যবস্থা উন্নত হবে।” কিশতওয়ার জেলার একজন তরুণ কৃষক মোহাম্মদ আসলাম জানিয়েছেন, “এই পাহাড়ি অঞ্চলে বিদ্যুতের সমস্যা দীর্ঘদিনের। এই বাঁধ তৈরি হলে শুধু আলো আসবে না, আমাদের জীবনেও আসবে উন্নয়নের আলো।” আবার অন্যদিকে পরিবেশবিদদের একাংশও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, “যে অঞ্চলে এই বাঁধ তৈরি হচ্ছে তা ভূকম্পপ্রবণ এলাকা। যদি যথাযথ মান বজায় না রাখা হয়, তবে ভবিষ্যতে বড়সড় বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।” তবে সরকারের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে, আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে সমস্ত নিরাপত্তা এবং পরিবেশগত দিক বিবেচনা করেই কাজ চলছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে NHPC (National Hydroelectric Power Corporation), যাদের অভিজ্ঞতা বহু দশকের। বাঁধ তৈরি হলে অন্তত ৩০০০ মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হবে এবং আরও হাজারো মানুষ পরোক্ষভাবে উপকৃত হবেন। কিশতওয়ার শহরের এক হোটেল ব্যবসায়ী জানান, “এই বাঁধকে ঘিরে প্রচুর ইঞ্জিনিয়ার, কর্মী, এবং পর্যটক আসছেন, যার ফলে আমাদের ব্যবসাও বাড়ছে।” তবে চন্দ্রভাগা বাঁধ শুধু একটা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্প নয়, বরং তা হয়ে উঠছে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের এক নতুন মোড়। পাকিস্তান ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে এবং বিশ্বব্যাঙ্ককে এই প্রকল্পে ঋণ না দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।

কিন্তু ভারত তার অবস্থানে অনড় থেকে বলেছে, এই প্রকল্প দেশের নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার অঙ্গ। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, “ভারতের এই প্রকল্প যদি চুক্তির সীমার মধ্যে থাকে, তবে পাকিস্তানের আপত্তি আন্তর্জাতিক মঞ্চে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না।” ইতিমধ্যেই প্রকল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, সিমেন্ট, লোহা, কংক্রিটের ট্রাক দিনে দিনে কিশতওয়ারের পথে ঘাটে দেখা যাচ্ছে। পাহাড় কেটে তৈরি হচ্ছে নতুন রাস্তা, সুড়ঙ্গ, জলাধার। এমনকি স্থানীয় এক স্কুলছাত্রীর কথায়, “আগে যেখানে অন্ধকার ছিল, এখন সেখানে আলো আসছে।” এই বাঁধ কেবল একটি উন্নয়ন প্রকল্প নয়, এটি জম্মু-কাশ্মীরের প্রতিটি মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেচ, ব্যবসা, পরিবহন—সবক্ষেত্রেই এই প্রকল্পের প্রভাব আগামী দশকে দৃশ্যমান হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও পাকিস্তানের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক চাপ থাকবেই, ভারত তার এই উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ থেকে পিছপা হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। সবশেষে, চন্দ্রভাগা নদীর ওপর কোয়ার বাঁধ ভবিষ্যতের ভারতের জন্য এক শক্তিশালী দৃষ্টান্ত হতে চলেছে—যেখানে উন্নয়ন, পরিবেশ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেই এগিয়ে যাবে ভারত।