Himachal devastated by looting, 5 dead, 16 missing : গত ২৪ ঘণ্টায় হিমাচল প্রদেশ যেন প্রকৃতির নিষ্ঠুর রোষানলে পড়ে এক বিভীষিকাময় রাত কাটাল। অন্তত ১১ বার মেঘভাঙা বৃষ্টিতে রাজ্যজুড়ে ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, আর জীবন-জীবিকা। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মন্ডী জেলায়, যেখানে সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে রেকর্ড ২৫৩.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই অতি বৃষ্টির ফলে মন্ডী, কুলু, হামিরপুর, ও লাহৌল-স্পিতি জেলায় ঘটেছে চারটি হড়পা বানের ঘটনা, যার জেরে ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫ জন মানুষ এবং নিখোঁজ রয়েছেন আরও অন্তত ১৬ জন।
প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, নিখোঁজদের খোঁজে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় অভিযান চালাচ্ছে এনডিআরএফ, এসডিআরএফ, পুলিশ ও হোমগার্ডের যৌথ দল, এবং যাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তাঁদের আপাতত অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে রাখা হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সোমবার রাত থেকে পুরো মন্ডী জেলায় ২৪৮টি রাস্তা বন্ধ হয়ে পড়েছে, যার ফলে বহু এলাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে রাজ্যের বাকি অংশ থেকে। গোটা হিমাচল জুড়ে বন্ধ রাস্তার সংখ্যা ৪০৬। শুধু তাই নয়, মন্ডী ও হামিরপুরে সমস্ত স্কুল ও কলেজ আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের তরফে। মন্ডীর শ্যামনগরের বাসিন্দা বৃদ্ধা সরোজ ঠাকুর কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার ছাগলগুলো পাহাড়ে ছিল, হঠাৎ সব ভেসে গেল। কীভাবে বাঁচব জানি না, আমার ঘরটাও ভেঙে গেছে।
” শুধু মানুষের প্রাণহানি নয়, মারা গেছে অন্তত ৩০টিরও বেশি গবাদি পশু, যা পাহাড়ি গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ভয়াবহ ধাক্কা। এছাড়া মন্ডী জেলায় ভেঙে পড়েছে একটি সেতু, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৪টি বাড়ি ও ১২টি পশুখোঁয়াড়। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিকল হয়ে গেছে ৯৯৪টি বিদ্যুৎ ট্রান্সফর্মার, যার ফলে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রাত কাটাতে হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। সাধারণ মানুষ জল, বিদ্যুৎ ও খাদ্যের সঙ্কটে ভুগছেন। নদীগুলোর জলস্তর ক্রমেই বাড়ছে, বিশেষ করে বিপাশা নদীর পান্ডোহ বাঁধ থেকে হঠাৎ করে ১.৫ লক্ষ কিউসেক জল ছাড়ার পর পরিস্থিতি আরও ভয়ানক রূপ নিয়েছে। স্থানীয় এক প্রৌঢ় কৃষক ভগৎ সিং জানিয়েছেন, “বাঁধ থেকে জল ছাড়ার পরে আমার খেত পুরোটাই ভেসে গেছে। এই বর্ষায় ফসলের ক্ষতি হয়ে গেল। এখন আমাদের একবছরের খাবার কোথা থেকে আসবে?” ইতিমধ্যেই সরকারি হিসাবে জানা গেছে, এবারের বর্ষা শুরু হওয়ার পর, অর্থাৎ ২০ জুন থেকে রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন ধস, বন্যা ও দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ৫০০ কোটি টাকা।
মন্ডী জেলার পুলিশ সুপার সাকশি ভারদ্বাজ জানিয়েছেন, “নদীগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দ্রুত উদ্ধার ও পুনর্বাসনের কাজ চলছে। পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টির মাত্রা আর একটু বাড়লেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।” বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিমাচলে এমন হঠাৎ মেঘভাঙা বৃষ্টি ও হড়পা বানের পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব। হিমবাহ গলে যাচ্ছে দ্রুত, আর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বৃষ্টির ধরণও বদলে যাচ্ছে। স্থানীয় পরিবেশবিদ অনুরাধা শর্মা বলেন, “হিমাচলের মতো পাহাড়ি এলাকায় যদি এইভাবে বৃষ্টির ধরণ বদলায়, তাহলে প্রতি বছর হড়পা বানে প্রাণহানি বাড়তেই থাকবে। আমাদের পরিকল্পনা নিতে হবে আরও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন ও সতর্কতার ভিত্তিতে।” এই দুর্যোগের মুখে যেমন রাজ্য প্রশাসন উদ্ধার ও ত্রাণে ব্যস্ত, তেমনি মানুষজন একে অপরকে সাহায্য করতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। স্থানীয় স্কুলগুলিকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রূপান্তর করা হয়েছে, যেখানে মহিলারা রান্না করছেন, যুবকরা স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করছেন, এবং শিশুরা ভয় কাটিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে। এমনই এক ত্রাণকেন্দ্রে ১১ বছরের কন্যা শিশিরা বললো, “আমি খেলতে চাই, আবার স্কুলে যেতে চাই।”
এই শিশুদের স্বপ্ন যেন আবার জেগে ওঠে, এই প্রার্থনা নিয়েই হিমাচলবাসী নতুন করে লড়াই শুরু করেছে। তবে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এও জানানো হয়েছে, যেহেতু বর্ষার সময় এখনই শুরু, তাই পাহাড়ি এলাকার মানুষদের আগাম সতর্ক থাকা দরকার, এবং আবহাওয়া দফতরের পরামর্শ মেনে চলার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এই সংকটময় সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য চেয়ে পাঠানো হয়েছে, এবং আশা করা হচ্ছে, অতিসত্বর কিছু আর্থিক সাহায্য ও পুনর্বাসনের প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে। শেষ কথা হল, প্রকৃতির সামনে মানুষ আজও কতটা অসহায়, তা আবারও প্রমাণ করে দিল হিমাচলের এই বিপর্যয়। কিন্তু একসাথে লড়ার মনোবল, মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানো আর প্রশাসনের দ্রুত তৎপরতা হয়তো আগামী দিনে কিছুটা আশার আলো দেখাবে।