Heinrich Klaasen retires from international cricket : ২০২৪ আর ২০২৫—এই দুই বছরের সন্ধিক্ষণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যেন এক গভীর আবেগঘন অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে উঠছে। একের পর এক পরিচিত মুখ, প্রিয় তারকা, যারা একদিন ক্রিকেট মাঠে ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষের ঘাম ছুটিয়ে দিত, সেই তারকারাই একে একে তাঁদের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানছেন। কিছুদিন আগেই রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের মত ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক ফরম্যাটকে বিদায় জানিয়েছেন। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হল দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম নির্ভরযোগ্য উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান হেনরিখ ক্লাসেনের নাম। সোমবার একটি আবেগঘন সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে ছবি দিয়ে তিনি ঘোষণা করেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন তিনি। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা ছিল—“এটা আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তগুলোর একটি। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলাটা আমার কাছে সবচেয়ে বড় সম্মান। কিন্তু এখন সময় এসেছে পরিবারকে প্রাধান্য দেওয়ার।” সেই একটি লাইনে যেন আটকে গেলেন হাজারো ক্রিকেটপ্রেমী।
হেনরিখ ক্লাসেন—যাঁকে বলা হয় দক্ষিণ আফ্রিকার ‘গ্লাভসম্যান’ ও ‘মিস্টার রিলায়েবল’, যিনি ব্যাট হাতে গতি পাল্টে দিতে পারতেন, আবার উইকেটের পেছন থেকে ফিল্ডারদের নির্দেশ দিয়ে খেলাটাকে পড়ে নিতে পারতেন নিখুঁতভাবে। দেশের হয়ে তিনি খেলেছেন ৪টি টেস্ট, ৬০টি ওডিআই এবং ৫৮টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ, যার মধ্যে ওডিআই ফর্ম্যাটে তাঁর সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল ১৭৪ রান—এক মারকুটে ইনিংস যা আজও ক্রিকেটপ্রেমীরা ভুলতে পারেননি।
দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সি গায়ে, পিচের ওপর ক্লাসেন যেন এক ‘অ্যাংকর’—কখনও ইনিংস গড়ে দেওয়া, কখনও আবার ধ্বংসস্তূপ থেকে দলকে টেনে তুলে আনা, সেই রকম এক প্রতিভাবান ক্রিকেটার। ২০২৩ সালের ওডিআই বিশ্বকাপে তাঁর ব্যাটিং ছিল দলকে প্লে-অফে পৌঁছে দেওয়ার অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের ব্যাটিং অর্ডারেও পরিবর্তন আসে—এবার সেই পরিবর্তন ঘোষণা করলেন ক্লাসেন।
বিশ্বক্রিকেটে ইতিমধ্যেই বড় বড় নাম আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে সরে যাচ্ছেন। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল তাঁর অবসর ঘোষণার সময় বলেছিলেন, “২০২৭ ওডিআই বিশ্বকাপ তরুণদের জন্য হোক।” ক্লাসেন যেন সেই পথই অনুসরণ করলেন। তাঁরও বক্তব্য, “ক্রিকেট আমার জীবনের অন্যতম দায়িত্ব ছিল, কিন্তু এখন আমি পরিবারকে সময় দিতে চাই। বাবা হিসেবে, স্বামী হিসেবে কিছু দায়িত্ব আছে, যেগুলো এবার পালনের সময় এসেছে।” এই আবেগঘন বার্তাটি যেন মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায় ক্রিকেটবিশ্বে। সতীর্থ থেকে সমর্থক, প্রত্যেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভালোবাসা জানাতে থাকেন এই ক্রিকেটারকে।
দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ড এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “ক্লাসেন শুধু একজন দক্ষ ক্রিকেটারই নয়, মাঠে ও ড্রেসিংরুমে নেতৃত্বের প্রতীক ছিলেন। তাঁর অভাব অনুভূত হবে।” প্রাক্তন প্রোটিয়া অধিনায়ক এবি ডিভিলিয়ার্স টুইটারে লেখেন, “হেনরিখ, তুমি একজন নির্ভীক যোদ্ধা। দেশের জন্য যা করেছ, তা অবিস্মরণীয়। শুভকামনা তোমার জীবনের পরবর্তী ইনিংসের জন্য।”
যদিও ক্লাসেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে গেলেও, তিনি খেলবেন বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে। ইতিমধ্যেই আইপিএল, সিএসএ টি-২০, ও বিগ ব্যাশ লিগের মতো বিভিন্ন লিগে তাঁর নাম আছে। বিশেষ করে আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে তাঁর ব্যাটিং ঝড় এখনো সমর্থকদের মনে টাটকা। তাই ক্রিকেটপ্রেমীরা যেমন আন্তর্জাতিক আঙিনায় তাঁকে মিস করবেন, তেমনই আবার ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে তাঁর ব্যাটিং দেখতে পাবেন।
এই ঘোষণার পর দুঃখপ্রকাশ করেছেন বহু সমর্থক। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের এক ক্রিকেটপ্রেমী রোশান পিল্লাই বলেন, “ক্লাসেন চলে যাওয়াটা যেন একটা যুগের ইতি। ওর খেলা মানে ছিল আমাদের ভরসা। আমরা আন্তর্জাতিক ম্যাচে ওকে মিস করব।” কলকাতার এক আইপিএল ভক্ত অর্কা সেন জানান, “আমি সবসময় ক্লাসেনের বড় ফ্যান ছিলাম। আইপিএল-এ ও এখনও খেলবে, এটা স্বস্তির।”
যদিও ক্লাসেনের বিদায় শুধু একজন ক্রিকেটারের অবসরের গল্প নয়, এটা আজকের সময়ের বড় বাস্তবতার কথাও বলে—মানুষ হিসেবে ক্রিকেটারদেরও নিজেদের জীবনের জন্য সময় দরকার। মাঠের বাইরের জীবন, পরিবার, আত্মিক শান্তি—এসবের মূল্যও কম নয়। এবং ক্লাসেন সেই মূল্যই বুঝিয়ে দিলেন।
শেষ কথা বললে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এক ‘রিলায়েবল সোলজার’ হারালো—যিনি চুপচাপ, নিরবে, নিজের কাজটা করে গেছেন। হেনরিখ ক্লাসেন যেন সেই ক্লাসের ছাত্র, যিনি ক্লাসে খুব একটা নজরে পড়েন না, কিন্তু পরীক্ষার খাতায় সব সময় ৯০ প্লাস। আজ তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু তাঁর উপস্থিতি, পরিশ্রম আর খেলার প্রতি নিষ্ঠা আজীবন মনে রাখবে ক্রিকেটদুনিয়া।
