Saturday, July 12, 2025
Google search engine
Homeঅন্যান্যআবহাওয়াটানা বৃষ্টিতে জল ছাড়ল ডিভিসি, প্লাবিত ঘাটালের বিস্তীর্ণ এলাকা

টানা বৃষ্টিতে জল ছাড়ল ডিভিসি, প্লাবিত ঘাটালের বিস্তীর্ণ এলাকা

Heavy rains inundate vast areas of DVC, Ghatal : পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল ও চন্দ্রকোনা আবারও প্লাবিত। এই দৃশ্য নতুন নয়, কিন্তু কষ্টের ইতিহাসটা যেন কখনও বদলায় না। টানা কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টির জেরে ঘাটাল মহকুমা আগে থেকেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তার উপর ডিভিসি (দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন) জল ছাড়ার ফলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। নদীর জল বইছে খালবিল, রাস্তাঘাট উপচে গ্রামের পর গ্রামে। জল থৈ থৈ করছে ঘাটাল, চন্দ্রকোনা, দাসপুর, খড়ার মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। শতাধিক গ্রাম এখন কার্যত জলের নিচে। বাড়িঘর ডুবে গেছে, চাষের জমি নষ্ট হয়ে গেছে, দোকানপাট বন্ধ। পেট চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে বহু পরিবারের জন্য।

প্রতিদিনের মতো সকালটা শুরু হলেও, হঠাৎ করেই এক ভয়ঙ্কর জলছবি ভেসে ওঠে গ্রামের রাস্তায়। ঘাটাল শহরের পুরসভার সামনে থেকে শুরু করে চন্দ্রকোনার দিকের রাজ্য সড়ক ডুবে গেছে হাঁটু থেকে কোমর সমান জলে। যান চলাচল প্রায় বন্ধ। জরুরি পরিষেবা, যেমন অ্যাম্বুলেন্স কিংবা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বহু স্কুল বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন গর্ভবতী মহিলা, বয়স্ক মানুষ আর শিশুদের নিয়ে থাকা পরিবারগুলো।

স্থানীয় বাসিন্দা কৃষ্ণপদ জানা বললেন, “বছর বছর আমরা এই দুর্ভোগে পড়ি। মাটির ঘর, টিনের চাল — সব জলের নিচে চলে যায়। এবার তো আরও খারাপ অবস্থা। রেশন আনতে পারছি না, রান্না করতে পারছি না। ছোট ছেলেটাকে নিয়ে কীভাবে থাকব বুঝতে পারছি না।”

ডিভিসি সূত্রে জানা গেছে, দামোদর, কান্দা, বরাকর এবং মাইকোন নদীতে জলস্তর বিপজ্জনক হারে বাড়তে থাকায়, বাধ্য হয়ে তারা সোমবার রাত থেকে জল ছাড়া শুরু করে। প্রতিদিন কয়েক হাজার কিউসেক জল ছাড়া হচ্ছে পাঞ্চেত ও মাইথন বাঁধ থেকে। তার ফলে শক্তি নদী, শীলাবতী এবং কংসাবতী নদীর জলের উচ্চতা রীতিমতো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।

ঘাটালের এক প্রবীণ স্কুল শিক্ষক, বিমল দত্ত বললেন, “আমরা বারবার সরকারের কাছে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কার্যকর করার দাবি জানিয়ে এসেছি। কিন্তু সেগুলো কাগজেই রয়ে গেছে। প্রতি বছর জল প্লাবনে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়, মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। কিন্তু স্থায়ী কোনও সমাধান হয় না।”

ঘাটালের ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলায় ব্লকের বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে। স্কুলবাড়ি, পঞ্চায়েত অফিস, ক্লাব ঘরগুলিকে অস্থায়ী আশ্রয় শিবির হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। চাল, ডাল, জল, ওরস্যালাইন, মোমবাতি, ওষুধপত্র পাঠানো হয়েছে। তবে, স্থানীয় মানুষদের অভিযোগ — “ত্রাণ তো নামে আছে, কিন্তু আমরা পাই কোথায়?” বহু মানুষ বলছেন, প্রাথমিকভাবে কিছু ত্রাণ এলেও এখন একদম বন্ধ। অনেকেই জলে ভেসে নিজেদের রান্নাঘর থেকে চাল-ডাল তুলে আনছেন গামলায় করে।

চন্দ্রকোনার বাসিন্দা প্রতিমা মাইতি জানালেন, “জল এতটা বেড়েছে যে রান্না করার জায়গাও নেই। মাটির উনুন তো কবেই তলিয়ে গেছে। শিশুদের খাওয়ানোর মতো খাবার নেই। আমরা কয়েকটা পরিবার এক জায়গায় জড়ো হয়ে শুকনো খাবার খেয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছি।”

এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পানীয় জলের। অধিকাংশ টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় অনেকেই পুকুর কিংবা নদীর জল খাচ্ছেন। তার ফলে ডায়রিয়া ও পেটের রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটার আশঙ্কা প্রবল। স্বাস্থ্য দফতরের তরফে কিছু মেডিক্যাল টিম নামানো হয়েছে বটে, তবে এত বড় এলাকায় পর্যাপ্ত পরিষেবা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ছে।

জেলা শাসক রাহুল মজুমদার জানালেন, “ডিভিসি-র তরফ থেকে আগাম কোনও তথ্য দেওয়া হয়নি। ফলে আমরা প্রস্তুতি নিতে পারিনি। এখন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় উদ্ধার ও ত্রাণের কাজ চলছে।” তিনি আরও জানান, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সমস্যা চলতেই থাকবে।

ঘাটালের বিধায়ক শঙ্কর দোলই বললেন, “আমরা বিধানসভায় বারবার এই বিষয়টি তুলেছি। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও জানেন এই প্লাবনের ভয়াবহতা। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান অনুমোদন করছে না। মানুষকে রাজনৈতিক স্বার্থে বলি দেওয়া হচ্ছে।”

এদিকে রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই জাতীয় সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ বাঁধগুলির রক্ষণাবেক্ষণ কাজ ত্বরান্বিত করেছে। রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (SDRF) এবং সিভিল ডিফেন্স কর্মীদের পাঠানো হয়েছে। তবে বহু প্রত্যন্ত এলাকায় এখনও তারা পৌঁছাতে পারেনি।

ঘাটাল ও চন্দ্রকোনা ব্লকের বহু কৃষক জানিয়েছেন, খরিফ মরসুমের ধান চাষ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। জমিতে এখন জলই জল। বহু গরু-মহিষ ভেসে গেছে বা মারা পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক মাস খাবার জোগাড় করাও দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। বহু মৎস্যজীবী জানিয়েছেন, তাঁদের পুকুর ভেসে গেছে, মাছ সব জলের সঙ্গে মিলিয়ে গেছে।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ঘাটাল থেকে কলকাতা যাওয়ার বাস পরিষেবা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। ট্রেন লাইনে জল উঠে যাওয়ায় লোকাল ট্রেনও বন্ধ। বহু লোক কাজ করতে যেতে পারছেন না। ব্যবসা-বাণিজ্য স্তব্ধ। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় পড়ুয়ারাও ক্ষতিগ্রস্ত।

স্থানীয় এক সমাজকর্মী সোমনাথ জানা বললেন, “ঘাটালের মানুষ এখন জল নয়, ভবিষ্যতের ভরসা চায়। আমরা চাই স্থায়ী সমাধান। এটা দুর্যোগ নয়, এটা মানুষের তৈরি দুর্দশা। সরকার, ডিভিসি, এবং প্রশাসন— সবাইকে একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

এই পরিস্থিতিতে আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টাতেও দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায় আরও ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তার মানে, জলস্তর আরও বাড়তে পারে। ফলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এই দুর্দশার মাঝে একটাই আশার কথা — গ্রামের মানুষ নিজেরা একে অপরকে সাহায্য করছেন, কেউ নিজের নৌকা দিয়ে উদ্ধারে নেমেছেন, কেউ খাবার বিলি করছেন। মানবিকতা এখানেই এখনও জেগে আছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments