Tuesday, July 29, 2025
Google search engine
Homeঅন্যান্য'পর্যটনে হালিশহর' গড়ে তুলতে উদ্যোগী হালিশহর পৌরসভা

‘পর্যটনে হালিশহর’ গড়ে তুলতে উদ্যোগী হালিশহর পৌরসভা

Halishahar Municipality takes initiative to develop Halishahar for tourism:ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের অন্দরের এক নিঃশব্দ অথচ ঐতিহাসিক শহর হালিশহর আজ এক নতুন রূপের সন্ধানে। অনেকেই জানেন না, এই শহরের পুরনো নাম ছিল হাবেলিশহর। কথিত আছে, হুগলি নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে গড়ে ওঠা এই জনপদটির নামকরণ হয়েছিল ‘হাভেলি শহর’, যা আজকের হালিশহর। কিন্তু ইতিহাস আর ধর্মীয় ঐতিহ্যে মোড়া এই শহরটিকে এবার পুরোদমে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে কোমর বেঁধেছে হালিশহর পৌরসভা। ‘খবর বাংলা’ পত্রিকার পক্ষ থেকে আমরা পৌঁছাই হালিশহরে, কথা বলি স্থানীয় মানুষ ও পুরপ্রধানের সঙ্গে, ঘুরি নানা প্রাচীন স্থান, এবং খোঁজ নিই কীভাবে এই শহরটি ভবিষ্যতের পর্যটনের মানচিত্রে নিজের ঠাঁই করে নিতে পারে।

হালিশহর শহরটি ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিকতা—এই তিনের অপূর্ব সংমিশ্রণে ভরপুর। সাধক রামপ্রসাদ সেনের বসতভিটে এখনও বহু ভক্ত ও দর্শনার্থীদের তীর্থক্ষেত্র হয়ে রয়েছে। আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে এখানে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বহু দূরদূরান্ত থেকে লোক আসেন শুধুমাত্র একটি ‘দর্শন’-এর আশায়। স্থানীয় বাসিন্দা রতন দে জানান, “ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে গেছি রামপ্রসাদের বাড়ি, এখনও সেই অনুভূতি অন্যরকম, আজও অনেক কিছুই অক্ষত রয়েছে।” অন্যদিকে, চৈতন্য মহাপ্রভুর ‘চৈতন্য ডোবা’—স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, মহাপ্রভু এখানকার মাটি সংগ্রহ করতেন তিলক পরার জন্য—এই স্থানটিও এক অপার ধর্মীয় আকর্ষণ হিসেবে গড়ে উঠছে।

শুধু আধ্যাত্মিকতা নয়, হালিশহর পৌরসভার সংগ্রহশালাও ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এক মূল্যবান সম্পদ। সংগ্রহশালায় রয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ব্যবহৃত জাতীয় পতাকা, তাঁর স্বাক্ষরিত চিঠিপত্র, এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা স্মারক। হালিশহরেরই বাসিন্দা ও ইতিহাস গবেষক সোমনাথ মুখার্জি বলছেন, “এই শহরের অমূল্য ঐতিহাসিক সম্পদ বহুদিন অবহেলিত ছিল, এখন যদি ঠিকভাবে তুলে ধরা যায়, তাহলে হালিশহর দেশ-বিদেশের পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে।”

এই প্রেক্ষিতে হালিশহর পৌরসভার পক্ষ থেকে গৃহীত হয়েছে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা—‘পর্যটনে হালিশহর’। পুরপ্রধান শুভঙ্কর ঘোষ ‘খবর বাংলা’-কে জানালেন, “শুধু রামপ্রসাদের ভিটে বা সংগ্রহশালা নয়, শহরের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট মন্দির, চৈতন্য ডোবা, নদীর পাড়, এমনকি প্রাচীন হালিশহরের বসতিগুলোকে নিয়ে আমরা একটি পর্যটন সার্কিট তৈরি করতে চাই। মানুষ যদি বাইরে থেকে আসে, তাহলে তারা এসেও দেখতে পারবে শহরটি। শহরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্ম—সব কিছু একজায়গায় পাবে।”

এই প্রকল্পে জোর দেওয়া হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়নের উপর। ইতিমধ্যেই শহরের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানের রাস্তাঘাট সংস্কার শুরু হয়েছে। তৈরি হচ্ছে সাইনবোর্ড, তথ্যকেন্দ্র, পর্যটকদের জন্য বিশ্রামাগার এবং পথনির্দেশক মানচিত্র। এছাড়াও পরিকল্পনায় রয়েছে স্থানীয় হস্তশিল্প ও খাদ্য সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য ‘হালিশহর হাট’ নামে একটি স্থায়ী মেলা চালু করা, যেখানে দর্শনার্থীরা স্থানীয় খাবার, হস্তশিল্প ও লোকসংগীতের স্বাদ নিতে পারবেন।

তবে এই উন্নয়নের সাথে সাথে স্থানীয় বাসিন্দাদেরও সচেতন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। হালিশহরের শিক্ষিকা দীপ্তি সেন বলেন, “পর্যটক এলে শুধু পুরসভা বা সরকার লাভবান হবে না, বরং আমাদের ছেলেমেয়েরা গাইডিং, হস্তশিল্প, হোমস্টে এইসব কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে এগোতে পারবে।” একই মত একজন অটোচালক প্রশান্ত দে-রও। তিনি জানান, “পর্যটক এলে আমরাও চালকের কাজ পেয়ে উপার্জন বাড়াতে পারব।”

হালিশহর শহরের প্রাচীন সৌন্দর্য আর আধুনিক পরিকল্পনার এক নতুন মেলবন্ধনের সন্ধানেই চলছে এই প্রকল্প। যদিও এই পথে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে—যেমন শহরের কিছু জায়গায় যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, পর্যাপ্ত গণপরিবহনের অভাব, এবং পর্যটন ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের ঘাটতি। তবে পৌরসভা জানিয়েছে, রাজ্য পর্যটন দপ্তরের সহযোগিতায় তারা ধাপে ধাপে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করবে।

Screenshot 10 1

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে হালিশহর হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম ‘আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক পর্যটন’ হাব। বিশেষ করে কলকাতার কাছাকাছি অবস্থান ও ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের নিকটে থাকা হালিশহরকে একদিনে ঘুরে আসার মতো আদর্শ গন্তব্য করে তুলছে।

পরিশেষে বলা যায়, ‘পর্যটনে হালিশহর’ প্রকল্প শুধু একটি শহরের রূপান্তরের গল্প নয়, এটি এক পুরনো, নীরব শহরের নিজস্ব আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়ার লড়াই। শহরের প্রতিটি ইট, প্রতিটি গলি যেন আজ বলে উঠছে, “এসো, দেখে যাও আমাদের ইতিহাসের পাতা, আমাদের সাধনা, আমাদের স্মৃতি।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments