General policy 74 thousand Kaka TV : ভারতের রেলপথ যেন শুধুমাত্র স্টেশনের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা এই দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দিনে দিনে দূরত্ব বেড়েছে, ট্রেনের গতি বেড়েছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে চুরি, হেনস্থা, এমনকি মাঝে মধ্যেই ডাকাতির মতো ভয়াবহ ঘটনাও। ঠিক সেই প্রেক্ষাপটেই ভারতীয় রেলের তরফে নেওয়া হয়েছে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ — যাত্রী সুরক্ষায় দেশজুড়ে দূরপাল্লার ট্রেনের প্রায় ৭৪ হাজার কোচে বসানো হচ্ছে উন্নত মানের সিসিটিভি ক্যামেরা। এই সিদ্ধান্ত যেন একদিকে যেমন যাত্রীদের মনে নিরাপত্তার আলো জ্বালাচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে তুলছে কিছু গুরুতর প্রশ্ন, যা নিয়ে ইতিমধ্যেই তর্ক শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন মহলে।
রবিবার রেলের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক জানান, “প্রতিটি কোচে চারটি করে এবং প্রতিটি ইঞ্জিনে ছ’টি করে ক্যামেরা বসানো হবে। ক্যামেরাগুলি এমন প্রযুক্তিতে তৈরি, যা ঘণ্টায় ১০০ কিমি বেগেও স্পষ্ট ভিডিও ফুটেজ রেকর্ড করতে পারে। ইতিমধ্যেই পরীক্ষামূলকভাবে কিছু ট্রেনে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে এবং তা সফলও হয়েছে।” রেলমন্ত্রী স্বয়ং এই প্রকল্পে ছাড়পত্র দিয়েছেন, যা আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল রেলের নিরাপত্তা উদ্যোগকে। জানা গেছে, এই ক্যামেরাগুলিতে থাকবে ন্যাইট ভিশন, রিয়েল-টাইম মনিটরিংয়ের সুবিধা, এমনকি ক্লাউডে সংরক্ষিত থাকবে ফুটেজ, যাতে প্রয়োজনে তা পুলিশের সাহায্যে তদন্তে কাজে লাগে।
এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হবে প্রায় হাজার হাজার কোটি টাকা, কিন্তু রেলের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে — যাত্রী নিরাপত্তা এখন তাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। রেলের ডিজি (নিরাপত্তা) আর কে মালব্য বলেন, “যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা কোনওরকম আপোস করতে চাই না। যে কোনও হেনস্থা, অপরাধ বা দুর্ব্যবহারের অভিযোগ প্রমাণ করতে এই ক্যামেরা বড় ভূমিকা নেবে।”
তবে, সবকিছুই কি এতটা নিখুঁত? সমালোচকদের মতে, এই প্রকল্প অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু এর পাশাপাশি কিছু মৌলিক প্রশ্ন উঠছেই। গত কয়েক মাসে একের পর এক ট্রেন দুর্ঘটনা, যেমন ওড়িশার বালেশ্বরে ভয়াবহ দুর্ঘটনা বা করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সংঘর্ষ, গোটা দেশের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এই অবস্থায় ‘কবচ’ নামের স্বয়ংক্রিয় ট্রেন সিগন্যালিং সিস্টেমের প্রয়োগ, যা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে, তা নিয়ে কেন এখনও গড়িমসি চলছে, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
রেল নিরাপত্তা বিশ্লেষক অনির্বাণ ঘোষ জানান, “সিসিটিভি নজরদারি নিঃসন্দেহে জরুরি, তবে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যেমন ট্র্যাক মেন্টেন্যান্স, সিগন্যালিং সিস্টেম, ট্রেন কন্ট্রোল প্যানেল — এসবেও সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নইলে শুধুমাত্র অপরাধ কমাতে পারলেও, দুর্ঘটনা আটকানো সম্ভব হবে না।”
যদিও এই নতুন প্রকল্পে মানুষ স্বস্তি পাচ্ছেন। মালদহ থেকে কলকাতায় কাজে যাওয়া রত্না সাহা বলেন, “রাতে ট্রেনে একা সফর করতে ভয় লাগত, এখন জানলে যে ক্যামেরা আছে, মনটা অনেকটা স্থির হয়।” বর্ধমানের শিক্ষক তপন সিংহ বললেন, “ছাত্রীরা ট্রেনে উঠতে ভয় পেত আগে। এই উদ্যোগটা তাঁদের আত্মবিশ্বাস দেবে।”
এখানেই শেষ নয়। রেলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে ভবিষ্যতে প্রতিটি স্টেশন ও প্ল্যাটফর্মেও ক্যামেরার সংখ্যা বাড়ানো হবে, থাকবে আধুনিক কমান্ড কন্ট্রোল সেন্টার, যাতে রিয়েল টাইমে নজর রাখা যায় দেশের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন ও স্টেশনগুলির ওপর।
এদিকে এই বিশাল প্রকল্পের প্রযুক্তিগত অংশে সহায়তা দিচ্ছে বেশ কয়েকটি দেশি ও বিদেশি কোম্পানি। ‘ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড’, ‘রেলটেল’, ও ‘হানিওয়েল’-এর মতো সংস্থাগুলি এই ক্যামেরা তৈরিতে যুক্ত রয়েছে। একইসঙ্গে কিছু কিছু ক্যামেরা সরবরাহ করছে জাপানি এবং জার্মান সংস্থাও। এই প্রযুক্তি ট্রেনের গতি, আলো ও কম্পনের মধ্যেও স্থির ও পরিষ্কার ফুটেজ দিতে সক্ষম।
তবে এই উদ্যোগ সফল করতে হলে শুধু ক্যামেরা বসানোই যথেষ্ট নয় — দরকার উপযুক্ত মনিটরিং সিস্টেম, পর্যাপ্ত ট্রেনিংপ্রাপ্ত নিরাপত্তাকর্মী, এবং সেইসঙ্গে আইন প্রয়োগে কঠোরতা। না হলে এই প্রযুক্তি শুধুমাত্র একটি ‘শো-পিস’ হয়েই থেকে যাবে, এমনটাই মনে করছেন অনেক যাত্রী।
পরিশেষে বলাই যায়, ভারতীয় রেল এই প্রকল্পের মাধ্যমে এক নতুন দিশা দেখিয়েছে, যেখানে যাত্রী নিরাপত্তা শুধুমাত্র কথা নয়, তা বাস্তবে রূপ পেতে চলেছে। তবে প্রকৃত নিরাপত্তা তখনই নিশ্চিত হবে, যখন নজরদারির পাশাপাশি দুর্ঘটনার প্রতিরোধে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার হবে এবং প্রতিটি যাত্রী নিশ্চিত থাকবেন — ট্রেনে উঠে যেমন গন্তব্যে পৌঁছবেন ঠিকঠাক, তেমনই রক্ষা পাবেন সম্মান, সম্পদ ও প্রাণ। রেলের এই ক্যামেরা প্রকল্প হয়তো সেই দিকেই এক নতুন সূচনা।