Gajan festival begins in Nadia with rituals: চৈত্র মাস মানেই বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিতে শিব ঠাকুরের আরাধনাকে কেন্দ্র করে এক অনন্য উৎসব – গাজন। নদীয়া জেলায় এই উৎসবের আড়ম্বর আজও অমলিন। ঠিক যেমন প্রাচীনকালে পালিত হতো, আজও সেই নিয়ম-নীতি মেনেই শুরু হয়েছে গাজন উৎসব। বৃহস্পতিবার, বারুণী স্নানের শুভ লগ্নে ফুলিয়া কৃত্তিবাসের বয়ড়া গঙ্গা ঘাটে শিবভক্ত সন্ন্যাসীদের ঢল নেমেছে। শিবের পাট বা প্রতীকী প্রতিমাকে ভাগীরথী নদীতে স্নান করিয়ে এই গাজনের শুভ সূচনা করা হলো। এরপর শুরু হয় সন্ন্যাসীদের নানা ব্রত, উপবাস এবং শারীরিক কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে শিবের প্রতি ভক্তি নিবেদন।
গাজন উৎসবের প্রেক্ষাপট ও ঐতিহ্য
গাজন উৎসবের শিকড় বহু পুরোনো। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, চৈত্র মাস শিবের মাস। এই সময় শিবের আরাধনা করলে রোগমুক্তি, পার্থিব সুখ এবং মোক্ষ লাভ হয় বলে বিশ্বাস। তাই নদীয়া সহ আশেপাশের গ্রামগুলিতে গাজন উৎসব ঘিরে এক অন্যরকম আবেগ কাজ করে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন শিব ঠাকুরের বিশেষ পুজোর মাধ্যমে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে, তবে তার আগের দুই সপ্তাহ ধরে চলে ভক্তি আর ধর্মীয় আচার।
বারুণী স্নান এবং শিবপাট স্নান করানোর আচার
এদিন বারুণী তিথি উপলক্ষে গঙ্গার ঘাটে সকাল থেকেই শিবভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে। কৃষ্ণনগর, তাহেরপুর, বাদকুল্লা, হবিবপুর সহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পুজো উদ্যোক্তারা শিবের বানপাঠ নিয়ে গঙ্গার তীরে উপস্থিত হন। তারপর শিব ঠাকুরের প্রতীকী মূর্তি ভাগীরথীতে স্নান করিয়ে শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। শিবের স্নান সম্পন্ন হওয়ার পর শুরু হয় গাজন সন্ন্যাসীদের নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কেউ ভগবানের নামে ব্রত পালন করছেন, কেউ দেহশুদ্ধির জন্য নিরামিষ আহার করছেন।
এক গাজন সন্ন্যাসী জানালেন, “চৈত্র মাসের প্রথম দিন থেকেই আমরা নিরামিষ আহার পালন করি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় শিব ঠাকুরের আরাধনা ও গানবাজনা হয়। পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান চলবে।” তিনি আরও জানান, এই ব্রত কঠোর শারীরিক ও মানসিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পালন করা হয়। সারাদিন উপবাস, রাতে ভক্তিগীতি ও পুজো পার্বণ – এইভাবেই কাটে তাঁদের সময়।
গাজন উৎসবের আয়োজন
গাজন উৎসবের সময় গ্রামে গ্রামে মেলা বসে। অনেক জায়গায় কালী এবং শিবের যুগ্ম আরাধনা হয়। সন্ন্যাসীরা শরীরের কষ্ট সহ্য করে ভক্তির মাধ্যমে শিবের কাছে প্রার্থনা করেন। কেউ কেউ শরীরের উপর কাঁটা বিছিয়ে তার উপর শুয়ে পড়েন, কেউ আবার লোহার কাঁটা গাঁথেন গালে কিংবা জিভে। এর মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের আত্মিক শক্তি ও শিবের প্রতি নিঃস্বার্থ ভক্তির প্রমাণ দেন।
গাজনের সামাজিক গুরুত্ব
গাজন শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি গ্রামীণ সমাজে এক ধরনের সামাজিক বন্ধনের ভূমিকা পালন করে। শিবভক্তরা একত্রে উপবাস পালন করেন, পুজো দেন এবং নিজেদের কষ্ট ভাগাভাগি করেন। গ্রামীণ এলাকায় এমন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ নিজেদের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেন। এই উৎসব ধর্ম, সংস্কৃতি এবং সামাজিক ঐতিহ্যের এক সুন্দর মেলবন্ধন।
পরিবেশ ও গাজন উৎসব
গাজন উৎসবের আরেকটি দিক হলো পরিবেশের প্রতি সচেতনতা। শিব হলেন প্রকৃতির দেবতা। তাই ভক্তরা শিবের আরাধনার সময় প্রকৃতির সুরক্ষার প্রতিও জোর দেন। গাছ লাগানো, নদী পরিষ্কার রাখা এবং অপচয় না করার পরামর্শ দেন অনেক পুজো উদ্যোক্তা। এবারের গাজনেও এই বার্তা দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রভাব এবং পর্যবেক্ষণ
নদীয়ার মতো জেলাগুলিতে গাজন উৎসব রাজনৈতিক মহলেও গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চায়েত নির্বাচন এগিয়ে আসার কারণে রাজনৈতিক দলগুলিও গ্রামীণ ভোটারদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য এমন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। তবে এখানকার গাজন উৎসব রাজনৈতিক প্রভাব থেকে অনেকটাই দূরে থেকে ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতাকেই গুরুত্ব দেয়।

উৎসবের আনন্দে ভাসল নদীয়া
ফুলিয়া, বাদকুল্লা, কৃষ্ণনগর, হবিবপুরের মানুষজনের কাছে গাজন শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটি আবেগ। প্রতিদিনের ক্লান্তিকর জীবনের বাইরে এসে তাঁরা এই ক’দিন শুধুমাত্র শিবের আরাধনায় মেতে থাকেন। বিভিন্ন জায়গায় শিবের নৃত্য, কীর্তন, ভক্তিমূলক গানবাজনার আয়োজন করা হয়। মেলাতে বাহারি দোকান বসে, যেখানে গ্রামের মানুষজন কেনাকাটা করেন। শিশুদের জন্য নাগরদোলা, কৃত্রিম জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রোমাঞ্চকর যাত্রা, পুতুলনাচ সহ নানা বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে।
ভবিষ্যতে গাজন উৎসব আরও বিস্তৃত হবে
গাজন উৎসবের জনপ্রিয়তা দিনে দিনে বাড়ছে। গ্রামীণ এলাকায় এখন শহুরে সংস্কৃতির প্রভাব পড়লেও, এই ধরনের আঞ্চলিক উৎসব এখনও প্রাণবন্ত রয়েছে। মানুষজন চাইছেন এই উৎসবকে আরও বড় আকারে উদযাপন করতে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে এই সংস্কৃতি পৌঁছে দিতে। তবে সেই সঙ্গে পরিবেশের প্রতি যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন প্রবীণ ভক্তরা।
উপসংহার
গাজন উৎসব নদীয়া সহ বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিবের আরাধনার মাধ্যমে এই উৎসব শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানই নয়, এটি সামাজিক ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও প্রতীক। গাজন আমাদের শিখিয়ে দেয় যে ভক্তি, ধৈর্য এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে জীবনকে আরও উন্নত এবং অর্থবহ করা সম্ভব।