Free trade agreement signed between India and Britain : দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটল অবশেষে। ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যকার বহু আলোচিত ও বহু প্রতীক্ষিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) বৃহস্পতিবার সই হল দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের উপস্থিতিতে। ইতিহাসের পাতায় নতুন অধ্যায় লিখল এই চুক্তি, যা শুধু দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক নয়, কূটনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকেও এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের আলোচনার পরিসমাপ্তি, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পারস্পরিক আস্থার ভিত।ব্রিটেন ও ভারতের মধ্যে এই ধরনের চুক্তির আলোচনা শুরু হয়েছিল ২০২১ সালে, বরিস জনসনের শাসনকালে। এরপর ক্ষমতার পালাবদল, লিজ ট্রাসের স্বল্পকালীন শাসন এবং শেষমেশ ঋষি সুনাকের আবির্ভাব—এই সমস্ত রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যেও দুই দেশের মধ্যে আলোচনার সূত্র ধরে রাখা হয়। বিশেষ করে ২০২৩ সালে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে মোদি ও সুনাকের বৈঠক ছিল এই আলোচনার অন্যতম মোড় ঘোরানো পর্ব। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি এল ২০২৪ সালের শেষে, যখন ব্রিটেনের হাল ধরলেন কিয়ের স্টার্মার।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর দুই দিনের ব্রিটেন সফরের সময় কিয়ের স্টার্মারের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর, দুই নেতা একসঙ্গে ভারতের সঙ্গে ব্রিটেনের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এটি নিঃসন্দেহে মোদির এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।চুক্তির মূল আলোচ্য বিষয়ে ছিল—ভারতের পক্ষ থেকে অ্যালকোহল ও মোটরগাড়ির উপর আরোপিত আমদানি শুল্ক হ্রাস এবং ব্রিটেন অভিমুখী ভারতীয় কর্মীদের জন্য কাজের অনুমতির প্রক্রিয়া আরও সহজতর করা। দীর্ঘ আলোচনা এবং বারংবার দফায় দফায় বৈঠকের পর অবশেষে দুই পক্ষই একে অপরের অবস্থান বুঝে এসে এক সমঝোতার জায়গায় পৌঁছায়। প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের পর তিনি আরও বৈঠক করবেন রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে। যদিও এ সফরের সবচেয়ে বেশি নজরকাড়া দিক নিঃসন্দেহে এই বাণিজ্য চুক্তির স্বাক্ষর। বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে একটি নতুন অর্থনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ, শিল্পোন্নয়ন, এবং দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগে এক নতুন দিশা তৈরি হবে এই FTA-এর মাধ্যমে।” অপরদিকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও এক প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ভারত-ব্রিটেন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। এই চুক্তি আমাদের দেশের কর্মক্ষেত্রেও নতুন উদ্যম আনবে, বিশেষ করে ব্রিটেনে ভারতীয় প্রযুক্তি ও পরিষেবা খাতের অবদান আরও জোরদার হবে।”

নিয়ে ভারতের ব্যবসায়ী মহলে স্বস্তি দেখা দিয়েছে। মুম্বইয়ের শিল্পপতি নীলেশ আগারওয়াল বলছেন, “ব্রিটেনে আমাদের পণ্যের প্রবেশাধিকার এখন সহজ হবে। আমাদের টেক্সটাইল, গয়না, আইটি পরিষেবা এখন প্রতিযোগিতামূলকভাবে প্রবেশ করতে পারবে।” কলকাতার এক্সপোর্টার সায়ন্তন বসু জানালেন, “আমাদের বহুদিনের দাবি ছিল আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে স্পষ্টতা। এই চুক্তি আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা দেবে।”অন্যদিকে, ব্রিটেন অভিমুখী পড়ুয়া ও কর্মপ্রার্থীদের মধ্যেও উল্লাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হায়দরাবাদের একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দিব্যাংশু সেন বলেন, “এই চুক্তি শুধু বাণিজ্য নয়, মানবসম্পদের আদান-প্রদানেও অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে দুই দেশকে। ভারতে তৈরি স্কিলড লেবার এখন ব্রিটেনে আরও সুযোগ পাবে।” ও ব্রিটেনের মধ্যে এই FTA চুক্তি এমন এক সময়ে এল, যখন বৈশ্বিক অর্থনীতি সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, কোভিড-পরবর্তী আর্থিক ধাক্কা, এবং চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনের মধ্যেও এই দুই গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে এক শক্তিশালী বাণিজ্যিক সেতুবন্ধন তৈরি হল। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যকার বাণিজ্য দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলারে, যা এই চুক্তির পরবর্তী পর্যায়ে ৫০ বিলিয়ন ছুঁতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চুক্তি ভারতীয় অর্থনীতির জন্য এক সুসংবাদ। কারণ ব্রিটেন এখনও ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক হাব। এর ফলে ভারতীয় পরিষেবা খাত, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যালস, অটোমোবাইল ও শিক্ষা ক্ষেত্রেও নতুন বাজার তৈরি হবে। ভারতীয় ছাত্ররা কাজের ভিসার শর্ত শিথিল হওয়ায় আরও সহজে সেখানে থাকতে ও কাজ করতে পারবেন।

এই চুক্তির ফলে ভবিষ্যতে আরও বৃহত্তর আকারে যৌথ উদ্যোগ, সংস্থাগুলির পারস্পরিক বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বাড়বে বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি সংস্থা ভারতে তাদের ব্রিটিশ কারখানা স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছে, আবার বেশ কয়েকটি ভারতীয় সংস্থা লন্ডনে R&D সেন্টার স্থাপন করতে চাইছে।এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি একটি পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করতে পারে ভারতের অন্যান্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তিগুলির জন্য। ব্রিটেনের সঙ্গে তৈরি হওয়া এই আস্থার সম্পর্ক ভবিষ্যতে ইইউ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্য আলোচনায় প্রভাব ফেলতে পারে।সামগ্রিকভাবে, এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি শুধু দুই দেশের অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক সম্পর্ককেও এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই সফর এবং স্টার্মার সরকারের সদিচ্ছা দুই দেশকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান যেমন মজবুত হয়েছে, তেমনই ভারতীয় ব্যবসা ও শ্রমবাজার পেয়েছে এক বড় সুযোগ। আর্থিক, সামাজিক এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে এই চুক্তি নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।