Forest area affected by elephant attack:পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশ, বিশেষ করে ডুয়ার্স অঞ্চল বহুদিন ধরেই বন্যপ্রাণীর উপদ্রবে জর্জরিত। একদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য, অন্যদিকে জঙ্গলের লাগোয়া এলাকায় বাস করা মানুষের জীবনধারা প্রতিনিয়ত বিঘ্নিত হচ্ছে। মালবাজার মহকুমা সেইসব এলাকাগুলির অন্যতম, যেখানে প্রায়শই বন্য হাতির হানা সাধারণ মানুষের জীবনে বিভীষিকা সৃষ্টি করে। বিশেষত, শস্য ও গৃহস্থালির ওপর হাতিদের হামলা যেন এক রুটিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত কয়েক মাসে বহু এলাকায় হাতির হানার খবর উঠে এসেছে, কিন্তু এবার ঘটনাস্থল হলো মালবাজার ব্লকের ওদলাবাড়ি শান্তি কলনীর ডাঙ্গা পাড়া।
ঘটনার বিবরণ
গত শনিবার গভীর রাতে, প্রায় রাত আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে, প্রায় ২০ থেকে ২৫টি হাতির একটি দল ঢুকে পড়ে ওদলাবাড়ি শান্তি কলনীর ডাঙ্গা পাড়ায়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ধানখেত, সুপারিবাগান এবং সব্জিখেত। স্থানীয় কৃষকদের মতে, এই বিশাল হাতির দল যথেচ্ছভাবে তাণ্ডব চালায়, যার ফলে ধানখেত নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জলসেচ ব্যবস্থা, পাকা সুপারিগাছ এবং কলাগাছ।
গ্রামবাসী আবু হোসেন বলেন, “ধানখেতে মাত্র রোপণ করা হয়েছে ধান। তার ওপর হাতির পায়ের চাপে সব কিছু নষ্ট হয়ে গেল। পাকা সুপারিগাছ ভেঙে ফেলেছে। কম করে ৮০ থেকে ৯০টি সুপারি গাছ একেবারে শেষ। প্রচুর কলাগাছও খেয়ে নষ্ট করেছে। হাতিগুলো পেছনে ফেরানোর জন্য আমরা নিজেরাই পটকা ফাটিয়ে, হইচই করে জঙ্গলের দিকে তাড়াই। বন দপ্তরের কোনো লোক আসেননি।”
এই দুঃসময়ে হাতি তাড়াতে গিয়ে আহত হন স্থানীয় কৃষক লেবুয়া মহম্মদ। তাঁর বক্তব্য, “পাকা ধানখেত, সব্জি খেত বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এত বড় দল একসঙ্গে হানা দিলে কিছু করার থাকে না। গাছ ভেঙে, ফসল খেয়ে একেবারে সর্বনাশ করে দিয়েছে।”
সরকারি প্রতিক্রিয়া
যখন পরিস্থিতি এমন বিপজ্জনক এবং মানুষ জীবন-জীবিকা নিয়ে সংকটে, তখন সকলের নজর যায় প্রশাসনের ভূমিকার দিকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও পর্যন্ত বন দপ্তরের তরফে কোনও সদর্থক পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
একজন স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “হাতির তাণ্ডবের খবর পেয়ে আমরা বারবার বন দপ্তরে ফোন করেছি। কিন্তু কেউ এল না। আমাদের বলা হয়েছে যে যা ক্ষতি হয়েছে, তার বিস্তারিত রিপোর্ট অফিসে জমা দিতে হবে, তারপর সেই নথিপত্র উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হবে।”
এমন পরিস্থিতিতে যখন কৃষকের মাথায় হাত, তখন এই ধরনের ঠাণ্ডা প্রতিক্রিয়া জনমানসে হতাশা সৃষ্টি করছে। অনেকের মতে, এটা শুধু একদিনের ক্ষতি নয়, এটা একটা প্রক্রিয়াগত অব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি।
স্থানীয় মতামত
গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই এখন আতঙ্কিত এবং ক্ষুব্ধ। তাঁদের মতে, বারবার অভিযোগ করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। সমস্যার মূল কারণ হল, গ্রামের একেবারে পাশেই থাকা জঙ্গল, যেখানে রয়েছে তার দিয়ে ঘেরা এলাকা। কিন্তু সেই তারও এখন হাতির দলকে আটকাতে পারছে না।
স্থানীয় বাসিন্দা সুলেখা রায় জানান, “আমরা বহুবার বলেছি, হাতি চলে আসছে, কিন্তু কোনও স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দিনে দিনে ফসলের ক্ষতি বাড়ছে। এবার তো সুপারিবাগানটাই শেষ হয়ে গেল। ছোট কৃষকদের পক্ষে এই ক্ষতি সামলানো অসম্ভব।”
বিশ্লেষণ
এই ঘটনার পেছনে মূল কারণ দু’টি—প্রথমত, জঙ্গল সীমানার নিরাপত্তা বেষ্টনির দুর্বলতা এবং দ্বিতীয়ত, বন দপ্তরের প্রতিক্রিয়ার শ্লথতা। ডুয়ার্স অঞ্চলে বন্যপ্রাণীর বসবাস স্বাভাবিক হলেও, মানব বসতির এতটা কাছাকাছি এসে বারবার ফসল ও গৃহস্থালির ক্ষয়ক্ষতি প্রমাণ করে যে সংরক্ষণ ও মানুষের সহাবস্থানের মধ্যে এখনও ভারসাম্য গড়ে ওঠেনি।
বছরের এই সময়েই ধান ও সব্জি খেতের প্রধান উৎপাদনকাল। ফলে হাতির হামলার কারণে কৃষকের আর্থিক ক্ষতি গিয়ে দাঁড়ায় হাজার হাজার টাকায়। এবারে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ, স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, একেকজন কৃষকের জন্য কমপক্ষে ২০-৩০ হাজার টাকার সমান।
উল্লেখযোগ্যভাবে, হাতি-মানুষ সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ার পেছনে খাদ্যের খোঁজে হাতিদের বারবার গ্রামে চলে আসার প্রবণতা বড় কারণ। বনাঞ্চলের খাদ্যাভাব এবং ক্রমাগত জঙ্গল সংকোচন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।