Farmers in exchange for worthless flowers at the wrong time : বসন্ত এসে গেছে। শিমুলের গাছে লাল ফুল ধরেছে, কোকিলের কুহু-কুহু ডাক শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এই আনন্দের মধ্যেও পূর্ব মেদিনীপুরের ফুল চাষিদের মুখে বিষাদের ছায়া। অসময়ে ফুলের দাম না পেয়ে বাধ্য হয়ে ফুল ফেলে দিয়ে বিক্ষোভ করছেন তারা। এই সংকট যেন গ্রামের আরও একটি পুরোনো গল্পকে মনে করিয়ে দেয়, যেখানে পুজোর আনন্দ আর ধর্মীয় ঐতিহ্যই ছিল গ্রামের প্রধান উৎসব। চাউলখোলা গ্রামের দাস পরিবারের সেই দুর্গাপুজো, যা প্রায় দেড়শো বছরের পুরোনো, আজও একই নিয়মে মহাসমারোহে পালিত হয়। একসময় ওড়িশার রাজার দখলে থাকা এই এলাকায় পুজোর সূচনা করেছিলেন কুঞ্জবিহারী দাস। জঙ্গল পরিষ্কার করে তিনি প্রথম মা দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। তখন আশেপাশের প্রায় কুড়িটি গ্রামে কোনো পুজোর ব্যবস্থা ছিল না। দাস পরিবার সেই প্রয়োজন পূরণ করে আটচালার মন্দিরে দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিল।
এখন, সেই একই চাউলখোলা গ্রামের কাছে যখন ফুল চাষিরা তাদের কষ্টার্জিত ফসল রাস্তায় ফেলে দিচ্ছেন, তখন দুই ভিন্ন সময়ের গল্প যেন একসঙ্গে মিশে যায়। চাষিরা জানিয়েছেন, অসময়ের বৃষ্টির কারণে গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদি ফুলের সঠিক দাম পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় ফুল ব্যবসায়ী মৃণালকান্তি জানা বললেন, “আমাদের ফুল চাষের ওপরই জীবনযাত্রা নির্ভরশীল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা খুব সমস্যায় পড়েছি। ফুলের চাহিদা কমেছে, দামও পড়ে গেছে। ফলাফল হিসেবে আমাদের ফসল ফেলে দিতে হচ্ছে।”
অন্যদিকে, চাউলখোলা গ্রামের দাস পরিবারের পুজোয় আজও একই রীতিনীতিতে পূজা হয়। দেবীর প্রতি ভক্তি এবং গ্রামীণ ঐতিহ্য মেনে আজও পারিবারিক সদস্যরা মিলে পুজোর আয়োজন করেন। বাড়ির আড়াইশোর বেশি সদস্য পুজোর কটা দিন নাচ, গান, নাটক এবং নানা অনুষ্ঠানে মেতে থাকেন। দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বলেন, এই পুজো যেন শুধু দাস পরিবারের নয়, বরং আশপাশের সবার মিলিত উৎসব। আগে দশমীর দিন দেবীর প্রতিমা সমুদ্রের জলে বিসর্জন দেওয়া হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই রীতিতে পরিবর্তন এসেছে। এখন পিছাবনী পর্যন্ত সিঁদুর খেলার মধ্য দিয়ে পারিবারিক দিঘিতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।
এই পুজোর ইতিহাস যেন এক ধরণের শক্তি জোগায় ফুল চাষিদেরও। তাদের প্রতিবাদও একধরণের উৎসব, কিন্তু সেই উৎসবের রঙ বিষাদের। ফুল ফেলে প্রতিবাদ করতে গিয়ে চাষিরা বলেন, “আমাদের রক্ত-ঘামের পরিশ্রমের মূল্য যদি আমরা না পাই, তাহলে আমাদের কাছে এই ফুলও মূল্যহীন।” এদিকে, প্রতিবেশী জেলা হুগলির সিঙ্গুর ও পুরুলিয়াতেও একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অনিয়মিত আবহাওয়া, ফসলের দামে অস্থিরতা, এবং ন্যায্য বাজার মূল্যের অভাবে চাষিরা ক্রমশ সংকটে পড়ছেন। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান রমা দাস বললেন, “এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে চাষিদের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ জরুরি। তাঁদের কৃষিঋণ মুকুব, বিকল্প বাজার ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দিলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া যাবে।”
আবার পুজোর সময়ের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, এই গ্রামের দুর্গাপুজো আজও অনেকের কাছে আশ্রয়স্থল। দিঘা-মন্দারমনি যাওয়ার পথে অনেক পর্যটকও এই পুজো দেখতে আসেন। দেবীর সামনে মানত করেন, আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। স্থানীয় বাসিন্দা অনুপম জানা বলেন, “আমাদের পুজো যেমন ঐতিহ্যের প্রতীক, তেমনই আশা করি আমাদের ফুল চাষিদের সমস্যাও একদিন দূর হবে। প্রকৃতি এবং দেবী আমাদের নতুন পথ দেখাবেন।”
এই ঘটনার ভেতর দিয়ে একটা বড় প্রশ্ন উঠে আসে – যখন একটি গ্রাম তার পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারে, তখন কেন বর্তমান সমস্যার মুখে এই গ্রাম এবং এর চাষিরা এতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে? হয়তো উত্তর লুকিয়ে আছে যুগ যুগ ধরে চলা সামাজিক পরিবর্তন আর আধুনিক অর্থনীতির টানাপোড়েনে। চাষিদের এই ফুল ফেলে দেওয়া হয়তো আমাদের চোখ খুলে দেওয়ার একটি বার্তা।
একদিকে আটচালার পুজোয় মেতে থাকা দাস পরিবার, অন্যদিকে ফুলের মূল্য না পেয়ে রাস্তায় ফেলে দেওয়া ফুল চাষিদের বিক্ষোভ – এই দুই দৃশ্য যেন একই মুদ্রার দুই পিঠ। একটা পিঠে আনন্দ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আরেক পিঠে সংগ্রাম, হতাশা, এবং ন্যায্য অধিকারের দাবি। সময়ই বলবে, এই সংকটের থেকে চাষিরা কতটা মুক্তি পাবেন এবং গ্রামীণ অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াবে।