Family of Madhyamik examinee helpless after losing father:পরীক্ষা মানেই এক অদ্ভুত অনুভূতি, যেখানে উত্তেজনা, ভয় আর আশা একসঙ্গে মিশে থাকে। কিন্তু সেই পরীক্ষার আগে যদি জীবনের সবচেয়ে বড় শোক এসে পড়ে, তাহলে সেই মানসিক অবস্থা সামলানো কার্যত অসম্ভব হয়ে ওঠে। তবু বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে নিজের যন্ত্রণাকে জয় করে মাধ্যমিক পরীক্ষার কেন্দ্রে হাজির হলো পূর্ব বর্ধমানের বৈদ্যডাঙ্গা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী প্রিয়া মাহাতো। তার জীবন যেন একটা গল্পের মতো, যেখানে সাহস, লড়াই আর মানবিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত দেখা গেল।প্রিয়ার বাবা রাজু মাহাতো (৩৮) ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য। কিডনির সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি, কিন্তু পরিবারের আর্থিক অবস্থার কারণে সঠিক চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। কিছুদিন আগে হঠাৎ তাঁর অবস্থার অবনতি হয় এবং তিনি চিরবিদায় নেন। বাবার মৃত্যুতে ভেঙে পড়ে গোটা পরিবার, বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানরা। একদিকে স্বামীর মৃত্যু, অন্যদিকে সংসারের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেই চিন্তায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন প্রিয়ার মা।তবে সব শোককে দূরে সরিয়ে বাবার স্বপ্নকে পূরণ করতেই মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম দিন স্কুলের পরীক্ষার হলে পৌঁছায় প্রিয়া। অনেকেই ভেবেছিলেন সে হয়তো পরীক্ষা দিতে পারবে না, কারণ বাবার মৃত্যুতে মেয়েটি প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের এবং শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় সে সিদ্ধান্ত নেয় বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ করবে। তার মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “রাজু চেয়েছিল মেয়েটা পড়াশোনা করুক, বড় হোক। তাই আমি ওকে সাহস দিয়েছি, বাবার স্বপ্ন যেন নষ্ট না হয়।”প্রিয়ার সহপাঠীরা এবং শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, “ও খুব ভালো ছাত্রী। বাবার মৃত্যুর পর আমরা ভেবেছিলাম ও হয়তো পরীক্ষা দেবে না, কিন্তু ও এসেছে এবং পরীক্ষা দিয়েছে। সত্যিই ওর মানসিক শক্তি অসাধারণ।”তবে সমস্যা এখানেই শেষ নয়। বাবার মৃত্যুর পর এই পরিবার কার্যত দিশেহারা।সংসারে উপার্জন করার মতো আর কেউ নেই, খাবার কেনার টাকা পর্যন্ত নেই। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই মেমারী সম্প্রীতি ঐক্য নামে একটি সমাজসেবী সংগঠন এগিয়ে আসে। সংগঠনের সদস্যরা প্রিয়ার বাড়িতে এসে খাদ্যসামগ্রী এবং কিছু আর্থিক সাহায্য তুলে দেন।
শুধু তাই নয়, সংগঠনের তরফে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, “আমরা শুধু আজকের জন্য নয়, ভবিষ্যতেও প্রিয়ার পড়াশোনার দায়িত্ব নেব। উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে হলে আমাদের সাহায্য লাগবে, আমরা সব সময় পাশে থাকব।”এই খবর পেয়ে গ্রামবাসীরাও মুগ্ধ। একজন প্রতিবেশী বলেন, “এই মেয়েটার জীবনের লড়াই শুরু হয়েছে খুব ছোটবেলাতেই। কিন্তু যদি ভালো মানুষরা পাশে থাকে, তাহলে ও নিশ্চয়ই একটা ভালো ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে।”কাঁঠাল গাছি এলাকার অনেকেই এই ঘটনায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। রাজু মাহাতো ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ। সংসারের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করতেন, স্বপ্ন দেখতেন মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে বড় করবেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্নটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে গেল। গ্রামের এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, “রাজু ছোট থেকে কষ্ট করেই বড় হয়েছে। মেয়েকে ভালো রাখতে চেয়েছিল। আজ সে নেই, কিন্তু তার মেয়ে যদি উচ্চশিক্ষা পায়, তাহলে তার আত্মা শান্তি পাবে।”এই কঠিন সময়ে মেমারী সম্প্রীতি ঐক্যের উদ্যোগ শুধু প্রিয়ার পরিবারকেই নয়, গোটা সমাজকেই এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে—”সহানুভূতিই একমাত্র পথ”। সমাজের অনেক স্বচ্ছল মানুষ যদি এক ধাপ এগিয়ে এসে এমন অসহায় পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ান, তাহলে অনেক ছিন্নভিন্ন স্বপ্ন আবার নতুন করে জোড়া লাগতে পারে।কিন্তু এই পরিবার কীভাবে ভবিষ্যতে চলবে? বাবা চলে যাওয়ার পর সংসারের দায়িত্ব প্রিয়ার মায়ের ওপর। কিন্তু তিনি বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করবেন কীভাবে? একদিকে মেয়ের পড়াশোনা, অন্যদিকে সংসারের খরচ চালানো—এ এক ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ। এ প্রসঙ্গে মেমারী সম্প্রীতি ঐক্যের অন্যতম সদস্য বলেন, “আমরা শুধু সাহায্য দিয়েই থামছি না, আমরা চেষ্টা করব যাতে প্রিয়ার মা কোনো স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন।”

এই ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসনেরও নজর পড়েছে প্রিয়ার পরিবারের ওপর। ব্লক প্রশাসনের এক আধিকারিক বলেন, “আমরা বিষয়টি শুনেছি এবং দেখছি, সরকারি সাহায্য কীভাবে দেওয়া যায়। প্রয়োজন হলে আমরা আরও কিছু স্কিমের মাধ্যমে পরিবারটিকে সহায়তা করব।”প্রিয়ার শিক্ষকরা জানিয়েছেন, স্কুলের পক্ষ থেকেও কিছু সাহায্য করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। শিক্ষক অরূপ বিশ্বাস বলেন, “ওর পড়াশোনা যাতে কোনোভাবেই থেমে না যায়, সেটা আমরা নিশ্চিত করব। ও মেধাবী ছাত্রী, আমরা সবাই মিলে যদি সাহায্য করি, তাহলে ও নিশ্চয়ই এগিয়ে যাবে।”এদিকে, সামাজিক মাধ্যমে এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই অনেক সাধারণ মানুষও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে অর্থ সাহায্য করেছেন, কেউবা নতুন দিগন্ত ক্লাব বা অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।এই ঘটনা শুধুমাত্র প্রিয়া মাহাতোর লড়াই নয়, এটি প্রতিটি সেই ছেলেমেয়ের গল্প, যারা দারিদ্র্য, শোক ও কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে চায়। বাবার মৃত্যু প্রিয়ার জীবনে এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করেছে, কিন্তু সমাজের ভালো মানুষদের সহানুভূতি ও সাহায্য তার সামনে নতুন পথের দিশা দেখাচ্ছে।