Eat lychees, but be careful!:গরম পড়লেই বাজারে আসে রসাল, মিষ্টি, লালচে রঙের লিচু। রাস্তাঘাটে, ট্রেনে-বাসে কিংবা হাটে-মেলায় সর্বত্রই দেখা মেলে এই প্রিয় ফলের। শিশুরা যেমন দারুণ খুশি হয়ে লিচু খায়, তেমনি বড়রাও দুপুরের খাবারের পরে ঠান্ডা জলভরা পাতিলে রাখা লিচু খেয়ে তৃপ্তি পান। কিন্তু যতই সুস্বাদু হোক না কেন, ডাক্তারবাবুরা বারবার করে বলে দিচ্ছেন — “লিচু খান, কিন্তু সাবধানে!” কারণ এই ছোটো রসালো ফলটির মধ্যে যেমন পুষ্টিগুণ রয়েছে, তেমনি লুকিয়ে রয়েছে কিছু ঝুঁকিও, যা অসাবধানতায় বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

লিচুতে রয়েছে ভিটামিন সি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ক্যালসিয়াম ও পটাসিয়ামের মতো একাধিক উপকারী উপাদান। নিয়ম মেনে লিচু খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, হজমশক্তি বাড়ে, এমনকি ত্বকের ঔজ্জ্বল্যও ধরে রাখা যায়। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, লিচুতে থাকা পলিফেনল শরীরের কোষে জারণ প্রতিক্রিয়া কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু বিপদটা শুরু হয় যখন আমরা অতিরিক্ত খাই কিংবা ভুল সময়ে খাই। বিশেষ করে কাঁচা লিচু খেলে শরীরের ওপর পড়ে মারাত্মক প্রভাব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কাঁচা বা আধা-পাকা লিচুতে হাইপোগ্লাইসিন (Hypoglycin A) ও মেথিলিন সাইকোপ্রোপাইল গ্লাইসিন (MCPG) নামক দুটি রাসায়নিক থাকে যা শরীরে শর্করার মাত্রা হঠাৎ কমিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে শিশুরা যদি খালি পেটে অনেক লিচু খেয়ে ফেলে, তাহলে সেই অবস্থায় শরীর দ্রুত হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় চলে যায় এবং তার জেরে কোমা কিংবা মৃ*ত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিহার রাজ্যের মুজাফফরপুরে ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বহু শিশু এই ‘লিচু সিনড্রোম’-এর শিকার হয়েছে। প্রতি বছর গরম পড়তেই এই জেলার হাসপাতালগুলোতে এমন অসুস্থ শিশুদের ভিড় বেড়ে যায়। চিকিৎসকদের মতে, এসব শিশু সাধারণত গরিব ঘরের হয়, যারা রাতে ঠিক মতো খেতে পায় না এবং সকালে খালি পেটে লিচু খেয়ে ফেলে। ঠিক এই কারণেই পেট খালি থাকলে শিশুদের লিচু না খাওয়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
কলকাতার পিডিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ ডা. সৌম্যদীপ বসু বলছেন, “যদি লিচু খাওয়াতে চান, তবে অবশ্যই পরিপক্ক লিচু খাওয়ান এবং খাওয়ার আগে যেন পেট ভর্তি থাকে তা খেয়াল রাখুন। আর একসঙ্গে অনেক লিচু খাবেন না। প্রতিদিন ৫-৬টি লিচু শিশুদের জন্য যথেষ্ট।” তিনি আরও বলেন, “লিচুতে ফাইবারের পরিমাণ কম হওয়ায় বেশি খেলে পেটে গ্যাস, অম্বল, ডায়রিয়া এমনকি হজমের গোলমাল দেখা দিতে পারে।”
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও লিচু একেবারে নিরাপদ নয়। একদিকে এই ফলে প্রাকৃতিক চিনি বেশি থাকায় এটি ইনসুলিনের মাত্রা হঠাৎ বাড়িয়ে দিতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের তাই একেবারে কম পরিমাণে অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে লিচু খাওয়া উচিত। একইভাবে গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। অনেক সময় দেখা গেছে লিচু খেয়ে গর্ভবতী মায়েদের শরীরে অ্যালার্জি হয়েছে, জ্বর বা ইনফ্ল্যামেশন দেখা দিয়েছে, এমনকি গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব পড়েছে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো — ওষুধের সঙ্গে লিচু খাওয়া। কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক বা স্নায়ুজনিত ওষুধের সঙ্গে লিচু খেলে তা বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। তাই যারা নিয়মিত কোনো ওষুধ খান, তাঁদের উচিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে লিচু খাওয়া। আবার অনেক সময় দেখা যায়, যাঁদের শরীর অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা গ্যাসের প্রবণতায় ভোগে, তাঁদের পক্ষে লিচু বেশি খেলে অস্বস্তি বেড়ে যায়।

তবে এত সাবধানতার মধ্যেও এই ফলটি একেবারে বাদ দিয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ এটি শরীর ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে, ডিহাইড্রেশন কমায় এবং এক ধরনের প্রাকৃতিক টনিক হিসেবে কাজ করে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে—পরিমাণে খেতে হবে, এবং সঠিক উপায়ে খেতে হবে। অর্থাৎ, ঠান্ডা জলে ধুয়ে খাওয়া, পাকা ও সতেজ লিচু খাওয়া, খালি পেটে না খাওয়া এবং বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী বা ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা।
মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের এক লিচু ব্যবসায়ী হোসেন আলি জানান, “এবার ফলন ভালো হয়েছে, দামও তুলনামূলক কম। কিন্তু লিচু নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে। অনেকে মনে করেন লিচু খেলেই অসুস্থ হওয়া যায়, কিন্তু আসলে ভুল সময়ে ও ভুল উপায়ে খেলেই বিপদ হয়।” একই মত খাদ্য বিশেষজ্ঞ মীনাক্ষী ধর-এর। তিনি বলেন, “লিচু অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল, কিন্তু একসঙ্গে ১৫-২০টি লিচু খাওয়া কোনো অবস্থাতেই উচিত নয়। যেকোনো ফলই পরিমিত খাওয়া উচিত, না হলে তার উপকারের বদলে অপকার হয়।”
সুতরাং, গরমের দিনে ঠান্ডা লিচুর স্বাদ উপভোগ করুন ঠিকই, তবে সেটা হোক সচেতনতার সঙ্গে। একমুঠো লিচু খেয়ে প্রাণ জুড়িয়ে নিন, কিন্তু চিকিৎসকের উপদেশ মেনে ও নিজের শরীরের খেয়াল রেখেই এই ফল উপভোগ করুন। আর শিশুদের ক্ষেত্রে খালি পেটে লিচু খাওয়া যেন না হয়—এই বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখুন।