DVC water shortage increases, alert in riverside areas:-বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই দামোদর উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এক অদ্ভুত চাপা উত্তেজনা, কারণ মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধার থেকে হঠাৎ বেড়ে গেল জলছাড়ার পরিমাণ, আর তাতেই নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ, আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তার ছায়া। ডিভিসি (দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন) সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টির কারণে জলাধারগুলির জলস্তর বিপজ্জনক ভাবে বেড়ে গিয়েছিল, সেই কারণেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আজ সকাল থেকে মাইথন জলাধার থেকে ১৮,৭০০ কিউসেক এবং পাঞ্চেত জলাধার থেকে ২৭,৪০০ কিউসেক জল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪৬ হাজার কিউসেক—এটাই এই মরশুমে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জলছাড়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জলস্তর বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে দামোদর নদী ও তার সঙ্গে যুক্ত নদীগুলিতে, যেমন বরাকর, বরাকলা, কাঁসাই ইত্যাদি। দামোদর উপত্যকার বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে যেসব গ্রাম, শহর ও কৃষিভিত্তিক এলাকা রয়েছে, সেই সব অঞ্চলের মানুষজনের মধ্যে শুরু হয়েছে চরম উৎকণ্ঠা। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, হুগলি, হাওড়া, পূর্ব বর্ধমান, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার একাধিক নদী তীরবর্তী গ্রামে ইতিমধ্যেই প্রশাসনের তরফে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বহু স্থানে মাইকিং করে স্থানীয় বাসিন্দাদের নদীর ধার থেকে সরে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং একাধিক ব্লকে তৈরি রাখা হয়েছে ত্রাণশিবির। হুগলির গোগাট অঞ্চলের এক কৃষক ধনঞ্জয় পাল বলেন, “গতবারও এমন জল ছাড়ার পর আমাদের ধানখেত সব ডুবে গিয়েছিল। এবার যদি বৃষ্টির সঙ্গে জল এসে পড়ে তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে।
” হুগলির খানাকুলের নদীপাড়ে বসবাসকারী বৃদ্ধা সরলা দেবী বলেন, “মাইকিং শুনে খুব ভয় লাগছে। আমরা তো নদীর ধারেই থাকি। একে বৃষ্টি, তার উপর আবার জল ছাড়ল, কোথায় যাব বুঝতে পারছি না।” জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা হচ্ছে, আর জলস্তরের হঠাৎ কোনও বৃদ্ধি হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক জানান, “জল ছাড়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্লকস্তরে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। যেসব অঞ্চল নদীঘেঁষা বা অতীতে প্লাবনের শিকার হয়েছে, সেসব এলাকায় সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে। নৌকা, ট্রলার, উদ্ধারকারী দল, পানীয় জল ও শুকনো খাবার সব প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
” একইসঙ্গে রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরও সক্রিয় হয়েছে। জানা গেছে, নদীর গতিপথ ও জলস্তরের উপরে নজর রাখছে ড্রোন ও স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ। বিশেষ করে মাইথনের জল বড়জোড়া ও সালানপুর হয়ে দামোদরে নেমে আসার পথে যেসব এলাকায় আগে প্লাবন হয়েছে, সেগুলিকেই এখন গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এত পরিমাণ জল একসঙ্গে ছাড়া হলে নিচু এলাকার পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হয়ে পড়তে পারে। বিশেষত যদি কয়েক দিনের মধ্যেই আরও বৃষ্টি হয়, তাহলে এই জল ছাড়ার প্রভাব বহুগুণে বেড়ে যেতে পারে। পাঞ্চেত ও মাইথনের জলাধার নির্মাণ হয়েছিল দামোদর নদীর নিয়ন্ত্রণ ও বন্যা প্রতিরোধের লক্ষ্যে, কিন্তু প্রতি বছর বর্ষার সময় যখন একদিকে প্রবল বৃষ্টি, অন্যদিকে জলাধার পূর্ণ হয়ে যায়, তখন নিয়ন্ত্রিতভাবে হলেও যখন একসঙ্গে এত জল ছাড়া হয়, তখন নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষদের জীবনে সৃষ্টি হয় তীব্র সংকট। পশ্চিম বর্ধমানের সালানপুরের বাসিন্দা ও সমাজকর্মী রণজিৎ সাহা বলেন,
“জলাধার গুলি তো আমাদের রক্ষা করার কথা, কিন্তু প্রতি বছর জল ছাড়লেই আমাদের গাঁ-ঘর ডুবে যায়। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ, পুকুরে মাছ সব উড়ে যায়, বাড়িতে জল ঢুকে পড়ে। এবারও একই ঘটনা ঘটবে না তো?” রাজ্যের কৃষি দপ্তরের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, বেশ কিছু নিচু জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে জমিতে থাকা আমন ধান ও সবজি চাষ এই মুহূর্তে বিপদের মুখে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কৃষকদের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে—জমিতে জল নিকাশির ব্যবস্থা রাখতে এবং যদি সম্ভব হয় তাহলে মূল্যবান চারা অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে। অন্যদিকে পরিবেশবিদরা এই ঘটনার পিছনে জলাধার পরিচালনায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করছেন। তাঁদের মতে, বৃষ্টি শুরু হতেই যদি প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়মিতভাবে জল ছাড়া হতো তাহলে শেষ মুহূর্তে এমন বিপুল জল ছেড়ে দিতে হত না। এর ফলে হঠাৎ নদীর স্রোত বেড়ে গিয়ে একাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়ে, মানুষ ঘর ছেড়ে ত্রাণ শিবিরে যেতে বাধ্য হন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জলাধারের আশেপাশে যখন জল বেড়ে যায়, তখন জলাধার কর্তৃপক্ষ যেন আরও বেশি সক্রিয় থাকে, কারণ নদীর গতিপথ দ্রুত পরিবর্তন হয় এবং তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। অতীতেও দেখা গেছে, এই জলছাড়া যদি সঙ্গে ভারী বর্ষণ চলে আসে, তাহলে নদীর বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। এমন উদাহরণ রয়েছে ২০১৭ ও ২০২১ সালে। তাই প্রশাসনের এখন প্রয়োজন আগেভাগেই সকল স্তরে সমন্বয় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া, যাতে মানুষের প্রাণ ও সম্পত্তির ক্ষতি না হয়। আগামী কয়েক দিন আবহাওয়া আরও বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে, ফলে এই পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকেও সব জেলার জেলা শাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে নদী তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষদের নিরাপত্তা ও রিলোকেশন সংক্রান্ত সব ব্যবস্থা আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা হয়। জলসম্পদ দফতর, পঞ্চায়েত, স্বাস্থ্য ও সেচ দফতর—সবাই একসঙ্গে কাজ করছে বলে জানানো হয়েছে। তবে স্থানীয় মানুষের দাবি, শুধু সতর্কতা নয়, ভবিষ্যতে যেন প্রতি বছর এই জলছাড়ার প্রক্রিয়া আরও বিজ্ঞানভিত্তিক ও সমন্বিত পদ্ধতিতে হয়। কারণ প্রতিবছর একই চিত্র দেখলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অবসাদ তৈরি হয় এবং সেইসঙ্গে থাকে সর্বক্ষণ আতঙ্ক—“এই বুঝি জল এসে পড়ল।” এই আতঙ্ক দূর করা ও মানুষের মনে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এখন প্রশাসনের বড় দায়িত্ব।