Wednesday, April 23, 2025
Google search engine
Homeটপ 10 নিউসকাশ্মীরে হামলায় মৃত্যুর দুর্গাপুরের ভূমিপুত্র বিতানের

কাশ্মীরে হামলায় মৃত্যুর দুর্গাপুরের ভূমিপুত্র বিতানের

Durgapur’s son Bitan dies in Kashmir attack:ফের রক্তে ভিজল ভূস্বর্গ কাশ্মীর, ফের নিস্পাপ প্রাণ ঝরে গেল এক অন্ধকার ষড়যন্ত্রে। পাহাড়, নদী আর বরফে মোড়া স্বপ্নের শহর পেহেলগাঁও এবার রক্তাক্ত — যেখানে পর্যটকদের গাড়ির উপর আচমকা হামলা চালাল উগ্রপন্থীরা। সেই হামলাতেই প্রাণ হারালেন পশ্চিমবঙ্গের তিনজন পর্যটক, যাঁদের মধ্যে একজন হলেন আমাদেরই রাজ্যের সন্তান, দুর্গাপুরে জন্ম নেওয়া বিতান অধিকারী। বিতানের শৈশব কেটেছে ইস্পাত শহর দুর্গাপুরে, আর সেই কারণেই তাঁর মৃত্যু যেন এক গভীর ক্ষত হয়ে এসেছে গোটা শহরের বুকে। ছোটবেলায় যাঁর পায়ের দাপটে কেঁপেছে স্কুলের মাঠ, আজ তাঁর জন্যেই কাঁদছে সেই শহরের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি প্রতিবেশী, প্রতিটি স্কুলের শিক্ষক। পেশাগত জীবনে একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন বিতান, পড়াশোনা শেষ করে পাড়ি দিয়েছিলেন আমেরিকায়। সেখানেই কর্মরত ছিলেন তিনি। কিছুদিন আগেই স্ত্রীর সঙ্গে ছুটি কাটাতে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন, আর সেই ছুটির ফাঁকে বেরিয়েছিলেন কাশ্মীর ভ্রমণে। কে জানত, সেই সফরই তাঁর জীবনের শেষ সফর হবে! পেহেলগাঁওতে জঙ্গিদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল তাঁর প্রাণ, স্তব্ধ হয়ে গেল এক সম্ভাবনাময় জীবনের সমস্ত স্বপ্ন। দুর্গাপুরের ২০/২৮ সেকেন্ডারি রোডের ইস্পাত আবাসনে দীর্ঘদিন ছিল তাঁর পরিবার, বাবা বীরেশ্বর অধিকারী ছিলেন দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার একজন সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মী।

প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, বিতান ছোট থেকেই অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের, পড়াশোনায় মনোযোগী, বিনয়ী ছেলে ছিল। হর্ষবর্ধন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু, এরপর শিবাজী বয়েস হাইস্কুল এবং শেষমেশ বি.সি. রায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পাশ করেন। এক প্রতিবেশী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “ওর মতো ভালো ছেলে খুব কম দেখা যায়, আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে, ওর এমন পরিণতি মানতে পারছি না।” বিতান যে এলাকায় বড় হয়েছে, সেই ইস্পাত নগরীর আবাসন এখন নিস্তব্ধ, পরিচিত প্রতিবেশীরা চোখের জল ফেলছেন বারবার। কেউ কেউ স্মৃতিচারণ করে বলছেন, “ও কলকাতায় চলে গেলেও দুর্গাপুরকে কখনও ভোলেনি, মাঝেমধ্যে আসত, আমাদের খোঁজখবর নিত, একেবারে মাটির মানুষ।” সরকারি সূত্রে জানা গেছে, কাশ্মীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। পর্যটকদের উপর হামলার পর কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি বলেন, “কাশ্মীরকে রক্তাক্ত করে শান্তি বিঘ্নিত করার চেষ্টা কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। দোষীদের শীঘ্রই শাস্তি দেওয়া হবে।” এমন ঘটনার জেরে পর্যটকদের মধ্যে আবার নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন কাশ্মীরের পহেলগাঁও ও আশেপাশের এলাকায় নিরাপত্তা আরও জোরদার করেছে। তবে বিতানদের মতো সাধারণ, শান্তিপ্রিয় মানুষের উপর এই ধরনের আক্রমণ কেবল তাঁদের পরিবার নয়, গোটা দেশের হৃদয়কে বিদীর্ণ করেছে। বিতানের স্ত্রী, যিনি ওই সময় পাশে ছিলেন, তিনিও আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই পরিবারটির পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা দুঃখে স্তব্ধ। বিতানদের পরিবারের পাশে আমরা সবরকমভাবে আছি।” শহর দুর্গাপুরে অনেকেই বলছেন, বিতানদের মতো মানুষই তো দেশের সম্পদ, যাঁরা বিদেশে থেকেও দেশের মাটির টান ভোলেন না। সেই মাটির ছেলেকে যদি এমনভাবে প্রাণ দিতে হয়, তবে প্রশ্ন তো ওঠে, দেশের নিরাপত্তা কতটা মজবুত? বিশ্লেষকরা বলছেন, পর্যটনকেন্দ্র কাশ্মীরে যদি বারবার এমন হামলা হয়, তাহলে দেশের পর্যটন অর্থনীতি বড়সড় ধাক্কা খেতে পারে। স্থানীয় ব্যবসায়ী, হোটেল মালিকরা ইতিমধ্যেই পর্যটকদের বুকিং বাতিল হওয়ার খবর জানাচ্ছেন। সেনা বাহিনীর এক আধিকারিক জানিয়েছেন, “উগ্রপন্থীদের এই হামলার নেপথ্যে বৃহৎ ষড়যন্ত্র রয়েছে, পাকিস্তান সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় আরও নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।” বিতান অধিকারীর মৃত্যুর ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমেও শোকের ঢেউ উঠেছে। প্রাক্তন সহপাঠীরা ফেসবুকে, ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন স্মৃতিচারণা। “তোকে হারিয়ে আমরা কেউ স্বাভাবিক থাকতে পারছি না”, লিখেছেন কলেজ জীবনের এক বন্ধু। আমেরিকায় কর্মরত এক প্রবাসী বাঙালি জানান, “বিতান আমার সহকর্মী ছিল, মানুষ হিসেবে ও অতুলনীয়, এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।” বিতানদের পরিবার এখন কলকাতায়, তার মৃতদেহ দেশে আনার জন্য প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে। তাঁর বাবা-মা শোকে পাথর হয়ে গেছেন। মা একটাই কথা বলছেন, “আমার ছেলেটা ঘুরতে গিয়েছিল, ফিরল নিথর হয়ে, এটা কীভাবে মেনে নেব?” শুধু একজন পর্যটকের মৃত্যু নয়, বিতানদের মতো প্রতিটি নিরীহ সাধারণ মানুষের রক্ত যখন ভূস্বর্গের মাটিতে ঝরে পড়ে, তখন তা গোটা জাতির চেতনাকে নাড়িয়ে দেয়। দুর্গাপুর শহর বলছে, “আমরা হারিয়েছি আমাদের মাটি থেকে গজিয়ে ওঠা এক প্রতিভাকে, এক ভালোমানুষকে, আর এমন মৃত্যু যেন আর কোনো মায়ের কপালে না জোটে।” বিতান অধিকারীর রক্ত যেন প্রশ্ন রাখে এই সমাজের কাছে, প্রশাসনের কাছে, এবং আমাদের সবার কাছে— আমরা কি পারি না এমন একটা দেশ গড়ে তুলতে, যেখানে বিনা ভয়ে ঘুরতে যেতে পারে বিতানের মতো হাজারো মানুষ?

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments