Dumdum’s Motilal Colony Durga Puja, theme Creation in the midst of destruction:দমদমের বুকে গর্বের আর এক নাম ‘মতিলাল কলোনি সর্বজনীন দুর্গোৎসব’। বছর ঘুরতেই আবারও শুরু হয়ে গেল বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি, আর এবার যেন সেই প্রস্তুতির ছন্দেই অন্যরকম এক আবেগ, কারণ ২০২৫ সালে এই ঐতিহ্যবাহী পুজো ৭৫ বছরে পা দিল—এক কথায় প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী বর্ষ। শনিবার উল্টো রথের দিনে খুঁটি পুজো দিয়েই সূচনা হলো বছরব্যাপী সেই উদযাপনের। সকাল থেকেই এলাকাজুড়ে উৎসবের আমেজ, ঢাকের তালে ভেসে উঠল পুজো প্রাঙ্গণ। এই বছরের থিম “ধ্বংস মাঝে সৃষ্টি সাজে”। এক গভীর অর্থবোধক ভাবনা—যেখানে ধ্বংস, সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সমাজের বিপর্যয়ের মধ্যেও উঠে আসছে সৃষ্টির বার্তা, আশার আলো। থিম নির্মাতারা বলছেন, বর্তমানে মানুষ এক দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে—কখনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কখনও মানুষের তৈরি অরাজকতা, আবার কখনও প্রযুক্তির দৌড়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন। এই অবস্থার মধ্যেও কিভাবে নতুন কিছু গড়ে ওঠে, নতুন স্বপ্ন বুনে নেওয়া যায়, সেই গল্পই ফুটে উঠবে এইবারের দুর্গাপুজোয়।
প্যান্ডেল তৈরিতে থাকছে পরিবেশবান্ধব উপকরণের ব্যবহার—জুট, বাঁশ, মাটি, কাগজ ও পুরনো ইলেকট্রনিকস রিসাইকেল করে তৈরি হচ্ছে এক অভিনব মণ্ডপ, যা শহরের ব্যস্ত জীবনযাত্রার মধ্যেও এক স্বস্তির বাতাবরণ তৈরি করবে। পাশাপাশি, প্রতিমার গড়নেও থাকছে এই থিমের প্রতিফলন—মাতৃরূপে থাকবে একজন নির্মাতা, যিনি ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আবার গড়ে তুলছেন সভ্যতা। মতিলাল কলোনির বাসিন্দারা এই পুজোকে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক পুনর্গঠনের উৎসব হিসেবে দেখেন। এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু প্রজন্মের আবেগ, স্মৃতি ও ইতিহাস। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা গৌরহরি চক্রবর্তী বললেন, “আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন থেকেই এই পুজোর সঙ্গে জড়িত। আজও সেই একই ভালোবাসা দেখি নতুন প্রজন্মের চোখে।” স্থানীয় কাউন্সিলর জানান, “এই পুজো শুধু একটি পুজো নয়, এটি দমদমের সংস্কৃতির মেরুদণ্ড। প্রতিবছর এখানে যেভাবে থিমের মধ্যে দিয়ে সামাজিক বার্তা দেওয়া হয়, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।” খুঁটি পুজোর দিনে উপস্থিত ছিলেন দমদম পৌরসভার উপ-চেয়ারম্যান শ্রী বরুণ নট্ট, যিনি জানান, “মতিলাল কলোনির দুর্গাপুজো শুধু দমদম নয়, গোটা উত্তর কলকাতার গর্ব। থিমের মধ্য দিয়ে সচেতনতার বার্তা ছড়ানোই আজকের প্রয়াস হওয়া উচিত, আর এখানকার কমিটি সেই দায়িত্ব বারবার পালন করেছে।” উল্লেখ্য, ১৯৫০ সালে এই পুজোর সূচনা হয়েছিল মাত্র কয়েকজন উদ্যোগীর হাতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা উত্তর শহরতলির অন্যতম বৃহৎ ও জনপ্রিয় পুজোয় পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার দর্শনার্থী ভিড় করেন এই পুজো প্রাঙ্গণে, আর এবার থিম ও ৭৫ বছরের উদযাপনকে কেন্দ্র করে সেই সংখ্যায় আরও বৃদ্ধি হবে বলে আশাবাদী উদ্যোক্তারা। উৎসবের নিরাপত্তা, যান চলাচল, ভিড় নিয়ন্ত্রণ সবদিকেই নজর দিচ্ছে কমিটি।

ইতিমধ্যেই দমদম থানার সহযোগিতায় একটি বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এবছরের আকর্ষণ থাকবে সন্ধ্যা আরতির সঙ্গে পরিবেশ সচেতনতা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটি বিশেষ আলোকচিত্র প্রদর্শনী, যেখানে তুলে ধরা হবে থিমের অন্তর্নিহিত গভীর বার্তাগুলো। পাশাপাশি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন স্থানীয় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা, থাকবে বিভিন্ন লোকশিল্পীর পরিবেশনা। আরও উল্লেখযোগ্য যে, এবছর কমিটি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে যে সমস্ত সামগ্রী পুনর্ব্যবহারযোগ্য হবে এবং প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় জলদূষণ এড়াতে থাকবে আলাদা ব্যবস্থা। উদ্যোক্তা শ্রী সৌরভ বসু বললেন, “আমরা শুধু পুজো করি না, সমাজকে কিছু বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করি। তাই এবছর ‘ধ্বংস মাঝে সৃষ্টি সাজে’ থিমের মাধ্যমে আমরা চাইছি মানুষ আবার ভাবুক—কোথায় যাচ্ছি আমরা? কোথা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারি?” বাস্তবিকই এই ভাবনা আজকের সমাজে ভীষণ প্রাসঙ্গিক। বিশ্বজুড়ে যখন জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, সম্পর্কের অবক্ষয় এবং মানসিক অবসাদ নিয়ে চিন্তা বাড়ছে, তখন একটি দুর্গাপুজোর থিম যদি সবার মনে একটুও আশার আলো জাগাতে পারে, তবে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। মতিলাল কলোনির এই পুজো যেন শুধু ‘দর্শনীয়’ না হয়ে ওঠে—’বোধযোগ্য’ ও ‘মন ছুঁয়ে যাওয়া’—এই ভাবনাতেই গড়ে উঠছে প্রতিটি ইঞ্চি। এক কথায়, দমদমের মতিলাল কলোনির এই প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী দুর্গোৎসব শুধু এক পুজো নয়, এক বার্তা, এক আবেগ, এক সংগ্রামের মধ্যে আশার খোঁজ।