Digha – Puri ‘Dham’ controversy in full swing:-পশ্চিমবঙ্গের মন্দারমণি থেকে কিছু দূরে দিঘার সমুদ্রতটের বুক চিরে তৈরি হওয়া নতুন জগন্নাথ মন্দির নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে বিতর্কের ঝড় উঠেছে, তা এখন যেন সমুদ্রের ঢেউ ছাড়িয়ে রাজনীতির মঞ্চ কাঁপাচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহুদিনের স্বপ্ন—দিঘাতে এক বিশাল জগন্নাথ মন্দির তৈরি করে পর্যটন এবং ধর্মীয় ভাবগম্ভীরতা একসঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া, সেটি সফল হয়েছে বটে, কিন্তু সেই মন্দিরের নামের পাশে “ধাম” শব্দটি বসানো নিয়েই এখন গোটা ওড়িশা তেতে উঠেছে। কথায় বলে, “ধর্ম আর রাজনীতি—এই দুই মিলে কখনও কখনও এমন বিতর্কের আগুন জ্বলে, যা সহজে নিভতে চায় না।” ঠিক তেমনই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দিঘা-পুরী জগন্নাথ ধাম বিতর্ককে ঘিরে।পুরীর সেবায়েত সমাজ থেকে শুরু করে ওড়িশার আইনমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ হরিচন্দন পর্যন্ত সবাই এক সুরে বলছেন—“জগন্নাথ ধাম” একান্তই পুরীর ঐতিহ্য। তাদের দাবি, ১২০০ বছরের ইতিহাস, শাস্ত্র, পুরাণ, সবই বলে জগন্নাথ ধাম বলতে বোঝায় একমাত্র পুরী মন্দিরকে। সেখানে দিঘাকে ধাম বলা মানেই এই ঐতিহ্যের ওপর হাত বাড়ানো, একপ্রকার ‘মালিকানা চুরি’। এই বিতর্কের সূত্রপাত যদিও নতুন নয়। যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে দিঘার মন্দির তৈরি হয়েছিল, তখন থেকেই অনেক ওড়িশাবাসী চোখ রাঙাচ্ছিলেন, কিন্তু সম্প্রতি দিঘার মন্দিরকে সরকারি নথিতে ‘জগন্নাথ ধাম’ বলে উল্লেখ করার পরেই আগুনে ঘি পড়ে। ওড়িশা সরকার জানিয়েছে, তারা শীঘ্রই ‘জগন্নাথ ধাম’ শব্দবন্ধকে ট্রেডমার্ক করতে চলেছে, যাতে অন্য কোনো রাজ্য এই শব্দ ব্যবহার না করতে পারে। একক স্বত্বাধিকারের দাবিতে আইনি লড়াই শুরু করতে চায় তারা।

এই প্রসঙ্গে ওড়িশার আইনমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ হরিচন্দন বলেছেন, “দিঘার মন্দিরকে ধাম বলা মানেই আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবমাননা। জগন্নাথ ধাম বলতে শুধু পুরী বোঝাবে, এটাকে অন্যত্র ব্যবহার করা যায় না। তাই আমরা আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছি।” ওড়িশার সেবায়েত সমাজের প্রবীণ সদস্য অচ্যুতানন্দ মহাপাত্র বলেন, “যুগের পর যুগ ধরে আমাদের মন্দিরই জগন্নাথ ধাম। দিঘা নতুন মন্দির হতে পারে, তাতে আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু ধামের দাবি একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না।”অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের দিক থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ও প্রশাসন এখনো স্পষ্ট করে কোনো বিবৃতি না দিলেও, তৃণমূলের একাধিক নেতা বলছেন—“দিঘার মন্দির আমাদের রাজ্যের গর্ব। ধাম মানে শুধু পুরী নয়, মানুষের বিশ্বাস, আস্থা, আর ভক্তির স্থান। তাই দিঘার মন্দিরকে ধাম বলা অন্যায় নয়।” এক স্থানীয় তৃণমূল নেতা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, “আমরা তো বলছি না পুরী ধাম নয়। আমরা শুধু বলছি, দিঘার মন্দিরও ধাম হতে পারে। মা মাটি মানুষে মিশে থাকা এটাই বাংলার দর্শন।”এদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া। দিঘার এক ব্যবসায়ী বিপ্লব জানা বলেন, “মন্দিরটা হয়েছে, পর্যটক আসছে, আমাদের ব্যবসা বাড়ছে, এই ধাম বিতর্ক কেন? আমাদের দরকার শান্তি, কাজের পরিবেশ।” আবার এক ওড়িশার পর্যটক প্রকাশ পণ্ডা বললেন, “জগন্নাথ ধাম মানেই তো আমাদের গর্বের পুরী। এটা নিয়ে বিতর্ক ঠিক নয়, ইতিহাসের মর্যাদা থাকা উচিত।”
এই বিতর্ক শুধু দুই রাজ্যের মধ্যে আবেগ আর অহংকারের সংঘর্ষ নয়, এর গভীরে রয়েছে অর্থনীতি, পর্যটন, এবং রাজনৈতিক সমীকরণও। দিঘার মন্দির তৈরি হওয়ার পর থেকেই সেখানে পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট সবকিছুতেই লেগেছে নতুন উন্মাদনার ছোঁয়া। অন্যদিকে, ওড়িশার অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যদি দিঘা ধাম পরিচিতি পায়, তাহলে পুরীর গুরুত্ব কিছুটা হলেও কমে যাবে। সেই সঙ্গে রাজ্যের পর্যটন আয়ের ওপরও প্রভাব পড়তে পারে। এর ফলে দুই রাজ্যের মধ্যে পর্যটন-রাজনীতির এক অদ্ভুত টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।এই প্রসঙ্গে পর্যটন বিশেষজ্ঞ সুদীপ্ত সেনগুপ্ত বলেন, “এই বিতর্ক যদি রাজনৈতিক মঞ্চের বাইরে গিয়ে সমাধানের পথে না আসে, তাহলে ক্ষতি হবে দুই রাজ্যেরই। বাংলায় নতুন মন্দির তৈরি হোক, তাতে সমস্যা নেই, কিন্তু ইতিহাসের মর্যাদা ও মানুষের আবেগকে অবজ্ঞা করা ঠিক নয়। একইসঙ্গে দুই রাজ্য মিলিয়ে এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে উদযাপন করা উচিত।”

ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বোঝা যায়, যদি এই বিতর্ক আরও তীব্র হয়, তাহলে আইনি লড়াই থেকে শুরু করে সামাজিক আন্দোলন পর্যন্ত নানা রকম প্রভাব পড়তে পারে। দুই রাজ্যের রাজনৈতিক সম্পর্কেও টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে। ওড়িশা সরকার যদি ট্রেডমার্ক পায়, তাহলে দিঘা মন্দিরের নাম পরিবর্তন করতে হতে পারে, যা বাংলার মানুষের আবেগে ধাক্কা দেবে। আবার যদি দিঘা মন্দিরের নাম রাখা যায়, তাহলে পুরীর লোকজনের মনে ক্ষোভের আগুন জ্বলতে পারে আরও বেশি।সবশেষে বলা যায়, দিঘা-পুরী ধাম বিতর্ক কেবল একটি নামের লড়াই নয়, এটা দুই রাজ্যের আত্মমর্যাদা, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘর্ষ। এই বিতর্কের মাঝে সাধারণ মানুষ শুধু চায়—ভক্তি থাকুক, শান্তি থাকুক, আর রাজনীতি দূরে থাকুক। ইতিহাসের পাতা খুলে দেখলে বোঝা যায়, ধর্ম আর রাজনীতি কখনোই একসঙ্গে শান্তি নিয়ে আসে না। তাই প্রয়োজন সব পক্ষের সংযম ও সহমর্মিতা। না হলে একদিন এই ধাম বিতর্ক হয়তো নতুন কোনো বড় সমস্যার জন্ম দেবে।