Demand to identify protesters : কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অমান্য করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনও পর্যন্ত রাজ্যের ভেতরে অবস্থানরত ‘অবৈধ পাকিস্তানি নাগরিকদের’ শনাক্ত করে তাঁদের ভিসা বাতিলের কোনও পদক্ষেপ নেয়নি—এই অভিযোগ তুলে গোটা রাজ্যজুড়ে একধরনের রাজনৈতিক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ভারতীয় জনতা পার্টি। বিজেপি রাজ্য নেতৃত্ব সরাসরি আঙুল তুলেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনের দিকে। তাঁদের অভিযোগ, জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে গাফিলতি করছে রাজ্য সরকার, যার ফল হতে পারে ভয়াবহ। বিজেপি এবার এই ইস্যুকে সামনে রেখে রাজ্যের প্রতিটি জেলার জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে জোরালো অবস্থান বিক্ষোভে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই অঙ্গ হিসেবে সোমবার দার্জিলিং জেলা প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ করে দলীয় কর্মীরা, যার নেতৃত্বে ছিলেন জেলা বিজেপি সভাপতি অরুণ মণ্ডল। তিনি সংবাদমাধ্যমে স্পষ্টভাবে বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে নির্দেশ দিয়েছে, তাতে অবৈধভাবে ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের শনাক্ত করে তাদের ভিসা বাতিলের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই নির্দেশ মানতে নারাজ। আমরা প্রশাসনের কাছে জানতে চাই—এর পেছনে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে কিনা।”
এই ঘটনার সূত্রপাত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সাম্প্রতিক একটি নোটিস ঘিরে, যেখানে বলা হয়েছে, নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতে বসবাসকারী সমস্ত পাকিস্তানি নাগরিকের ভিসা পর্যালোচনা করে অবিলম্বে অবৈধদের সনাক্ত করতে হবে। ওই নির্দেশে ভিসা নবায়নের প্রক্রিয়াকেও আরও কঠোর করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই গুজরাট, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি এই নির্দেশ কার্যকর করেছে বলে খবর। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনও সেই প্রক্রিয়া শুরু করেনি বলে অভিযোগ রাজ্য বিজেপির।
বিজেপির রাজ্য মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “বাংলায় বড়সড় অনুপ্রবেশ হয়েছে বিগত দশকে। তার একটা বড় অংশ এসেছে পাকিস্তান থেকে, যাদের একাংশ হয়ত সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপেও যুক্ত। রাজ্য সরকার কি তাদের রক্ষা করছে? যদি না করে, তাহলে কেন এখনও পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি?” অন্যদিকে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এই অভিযোগ একেবারেই উড়িয়ে দিয়েছে। তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, “বিজেপি ভোটের আগে সবসময় সাম্প্রদায়িক ইস্যু খোঁজে। এখন আবার পাকিস্তানি খুঁজছে! বাংলায় কে কোথা থেকে এসেছে, সেটা জানার কাজ প্রশাসনের। সেই কাজ প্রশাসন করছে তার নিজের গতিতে। বিজেপি যা করছে তা শুধুই বিভাজনের রাজনীতি।”
এই ঘটনার জেরে রাজ্যের প্রশাসনিক মহলে একধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের দপ্তরে বিজেপির কর্মীদের অবস্থান বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হাতের বাইরে গেলে প্রয়োজনে ধারা ১৪৪ জারি করা হবে। কিন্তু তাতে বিজেপি কর্মীরা থামছেন না। বরং তাঁরা বলছেন, “যতদিন না পর্যন্ত রাজ্য সরকার অবৈধ পাকিস্তানিদের শনাক্ত করে পদক্ষেপ নিচ্ছে, ততদিন আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।”
অপরদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলির একাংশ এই ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ বলেই দেখছে। তাঁদের মতে, বিজেপি একদিকে যেমন জাতীয়তাবাদী আবেগকে ব্যবহার করছে, অন্যদিকে এর ফলে প্রকৃত রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। কলকাতা হাইকোর্টের এক অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবী এ প্রসঙ্গে বলেন, “ভারতের সংবিধান বলছে, কোন ব্যক্তি যদি নির্যাতনের কারণে এদেশে আশ্রয় নেন এবং প্রমাণ করতে পারেন, তবে তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়ার কোনো অধিকার সরকারের নেই। সব পাকিস্তানিকে অবৈধ বলা ঠিক নয়। বিষয়টি বিচারবোধ দিয়ে দেখতে হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ইস্যুতে বিজেপি রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিয়েই প্রশ্ন তুলে ফের জাতীয়তাবাদের জোয়ারে ভোট টানার চেষ্টা করছে। তবে এও ঠিক, যদি অবৈধ বিদেশিদের সংখ্যা সত্যিই বাড়ে, তবে নিরাপত্তা এবং জনসাধারণের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার ওপর তার প্রভাব পড়বে বলেই মনে করছেন অনেকে।
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়াও মিশ্র। কেউ বলছেন, “যদি কেউ অবৈধভাবে এখানে থাকে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।” আবার কেউ বলছেন, “পাকিস্তানি কি, ভারতীয় কি—সবাই মানুষ। আগে দেখে নেওয়া হোক প্রকৃত অপরাধী কে, তারপর বিচার হোক।”
এই ঘটনার ভবিষ্যৎ প্রভাব কী হতে পারে? প্রথমত, রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন আরও বাড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনের ওপরও চাপ বাড়বে এই চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া চালাতে গিয়ে। তৃতীয়ত, মানবাধিকার সংগঠন বনাম প্রশাসনের আইনি লড়াইও শুরু হতে পারে এই বিষয়কে ঘিরে।
সব মিলিয়ে ‘পাকিস্তানিদের চিহ্নিত করে ভিসা বাতিল’-এর মতো স্পর্শকাতর ইস্যু রাজনীতির মঞ্চে নতুন করে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। আগামী দিনে এই ইস্যু কোন দিকে গড়ায়, তা সময়ই বলবে। তবে এখনই যা পরিস্থিতি, তাতে বলা যায়—এই বিতর্কের কেন্দ্রে আবার একবার ‘পরিচয়’ আর ‘পরিচিতি’।