Death toll in Texas due to severe flooding, many missing : প্রবল বর্ষণে দিশেহারা আমেরিকার টেক্সাস। টানা কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিপাতের জেরে হঠাৎই শুক্রবার দক্ষিণ-মধ্য টেক্সাসে দেখা দেয় এক মর্মান্তিক বন্যা। গুয়াদালুপে নদীর জল হুহু করে বাড়তে থাকায় প্লাবিত হয় আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা। এখনো পর্যন্ত ২৪ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে, নিখোঁজ রয়েছেন বহু মানুষ। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে একটি সামার ক্যাম্পে, যেখানে ঘুরতে এসে নিখোঁজ হয়ে গেছেন অন্তত ২৫ জন স্কুলপড়ুয়া। বন্যা যেন আচমকাই আছড়ে পড়ে ওই এলাকায়, যা ঘুম ভাঙার আগেই গ্রাস করে চারপাশ। এক স্থানীয় বাসিন্দা, লুইস গঞ্জালেজ, বলেন— “রাতের অন্ধকারে হঠাৎই নদীর জল বাড়তে শুরু করে, আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের বাড়ির অর্ধেকটা জলের নিচে চলে যায়। সেভাবে কোনও সতর্কতাও পাইনি আমরা।” প্রশাসনের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, সতর্কতা জারি করতে সময় পাওয়া যায়নি কারণ জলস্তর এত দ্রুত বাড়তে থাকে যে যেকোনও ব্যবস্থা নেওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ২৩৭ জন বাসিন্দাকে। নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাজারেরও বেশি মানুষকে। নিখোঁজ শিশুদের খোঁজে নামানো হয়েছে উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার ও ড্রোন। টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট এক প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছেন— “উদ্ধার অভিযানে এখন পর্যন্ত ১৪টি হেলিকপ্টার, ১২টি ড্রোন এবং শত শত উদ্ধারকর্মী নিযুক্ত হয়েছে।
প্রতিটি প্রাণের সন্ধান পাওয়া আমাদের দায়িত্ব।” বিশেষ করে সামার ক্যাম্পে নিখোঁজ পড়ুয়াদের নিয়ে প্রশাসনের উদ্বেগ তুঙ্গে। সামার ক্যাম্পের আয়োজক লিন্ডা হার্ডিং জানিয়েছেন— “বাচ্চারা খুব খুশিতে ছিল, কেউ ভাবতেও পারেনি এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। রাত তিনটে নাগাদ হঠাৎ জল ঢুকে পড়ে, আমাদের কিছু করার সময়ই ছিল না।” ক্যাম্পের পাশে থাকা এক অভিভাবক, মারিয়া ফার্নান্দেজ, কাঁদতে কাঁদতে বলেন— “আমার মেয়ে ভ্যালেরি ক্যাম্পে গিয়েছিল। এখনো ওর খোঁজ পাইনি। এটা যেন দুঃস্বপ্নের মতো।” উদ্ধারকাজে সমস্যা হচ্ছে প্রবল জলস্রোতের কারণে। অনেক এলাকায় রাস্তা ভেঙে গিয়েছে, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। উদ্ধারকারী দলরা কাজ করছেন প্রাণ হাতে নিয়ে। মার্কিন আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, এই অঞ্চলে আগামী ৪৮ ঘণ্টা আরও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমন হঠাৎ বন্যা আগের তুলনায় অনেক বেশি ঘন ঘন হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিসের কর্মকর্তা মাইকেল বার্নস জানিয়েছেন— “গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে বৃষ্টির মাত্রা ও আচরণ দুটোই পাল্টে যাচ্ছে। এর ফলে নদীগুলি অতিরিক্ত জল ধারণ করতে পারছে না, ফলে হঠাৎ করে প্লাবন ঘটছে।” এই ঘটনায় টেক্সাসের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা বিভাগ (TDEM) ৩২টি কাউন্টিতে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। বহু স্কুল, কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে। জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে যাতে বন্যাকবলিত মানুষজন নিরাপদে থাকতে পারেন। প্রাথমিকভাবে যে ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই বয়স্ক ও শিশু। অনেকে ঘুমন্ত অবস্থায় প্লাবনের কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। চিকিৎসা ব্যবস্থাও বর্তমানে চূড়ান্ত চাপে। স্থানীয় এক নার্স, কিম্বারলি টাইলার বলেন— “আমরা যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করছি। প্রতিটি ঘন্টায় নতুন করে আহত কিংবা জলে ভিজে অসুস্থ মানুষ আসছেন।” উদ্ধারকাজে সহায়তা করছে ন্যাশনাল গার্ড এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি। টেক্সাসের গভর্নর জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফেডারেল সহায়তার আবেদন জানানো হয়েছে ও প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন— “আমরা এই দুর্যোগে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করব। এই লড়াই শুধু আমাদের রাজ্যের নয়, এটা মানবতার লড়াই।” এই ঘটনার জেরে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। একদিকে পরিবেশবিদরা সতর্ক করছেন জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ পরিণতির ব্যাপারে, অন্যদিকে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে— কীভাবে উন্নত দেশেও এমন অকস্মাৎ দুর্যোগে এতগুলো প্রাণহানি ঘটে যেতে পারে? সমাজকর্মী ও পরিবেশ আন্দোলনের মুখ সোফিয়া হারম্যান বলছেন— “এই বন্যা একটা অ্যালার্ম, আমাদের অবিলম্বে প্রকৃতির সঙ্গে সংঘর্ষ বন্ধ করতে হবে, নয়তো আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অন্ধকার।” ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড করছে #PrayForTexas ও #SaveTheChildren হ্যাশট্যাগগুলি। সাধারণ মানুষও এগিয়ে এসেছেন ত্রাণ পাঠাতে। কিছু অভিভাবক নিজেরাই উদ্ধার কাজে যোগ দিয়েছেন। ভারতীয় দূতাবাস থেকেও জানানো হয়েছে, টেক্সাসে বসবাসকারী ভারতীয়রা এখন পর্যন্ত নিরাপদ রয়েছেন, তবে পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা হচ্ছে। সবমিলিয়ে এই বন্যা শুধুই একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি যেন মানুষের অসহায়তার, অব্যবস্থার ও প্রকৃতির প্রতিশোধের এক নির্মম চিত্র। এখন সমস্ত নজর নিখোঁজ শিশুদের উদ্ধারের দিকে। পরিবারগুলির চোখে এখন শুধুই প্রশ্ন— “আমার সন্তান কি নিরাপদে আছে?” সময় বলবে এই বন্যা তাদের কাছে কেবল এক আতঙ্কের স্মৃতি হয়ে থাকবে, না এক চিরন্তন যন্ত্রণা।