Daily commuters demand repair of river banks, jetty ghats in poor condition: সুন্দরবনের বুকে আবারও প্রকৃত অবহেলার এক কঠিন বাস্তবতা উঠে এল আতাপুর খেয়াঘাট ঘিরে। উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি ২ নম্বর ব্লকের অন্তর্গত মনিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের আতাপুর থেকে খুলনার মধ্যে রায়মঙ্গল নদী পারাপারের খেয়াঘাট এখন কার্যত ভেঙে পড়ার মুখে। প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী এই নদীপথ ব্যবহার করলেও, সেখানে নেই নিরাপত্তার বালাই, নেই কংক্রিটের জেটি, নেই পর্যাপ্ত আলো কিংবা কোনও জরুরি পরিষেবা ব্যবস্থা। শুধুমাত্র কয়েকটি ভাঙা ইট, গাছের পিলার ও মাটি দিয়ে তৈরি একটি জরাজীর্ণ স্লিপার সাঁকো – সেটিই এখন সুন্দরবনের এই গুরুত্বপূর্ণ জলপথের ভরসা। অথচ ঠিক এই ঘাট দিয়েই নিত্যযাত্রী, রোগী, স্কুল পড়ুয়া এমনকি বাইক ও সাইকেল চালকেরা প্রতিদিন পার হন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।আতাপুরের বাসিন্দা তপন মাঝি বললেন, “জল যদি একটু কমে যায়, তাহলে জেটির শেষ প্রান্তে গিয়ে নৌকায় উঠতে হয়। মরা কোটালের সময় এমনটা রোজ হচ্ছে। সেই সময় একটু পা হড়কালেই নদীতে পড়ে যেতে হয়। এত বছর ধরে অনুরোধ জানিয়েছি, কিন্তু কিছু হয়নি।” আতাপুর খেয়াঘাট দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয়দের জন্য যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলেও এখনও পর্যন্ত সেখানে স্থায়ী কংক্রিটের জেটিঘাট তৈরি হয়নি। বর্ষার সময় তো আরও ভয়াবহ অবস্থা – তখন কাদামাটির মধ্যে পা পিছলে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে, আবার গ্রীষ্মে খরাপানিতে বহু নৌকা নদীতে পড়ে বসে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে ঘাট অন্ধকারে ডুবে যায়, কারণ নেই কোনও লাইটিং ব্যবস্থা, নেই কোনও নিরাপত্তা কর্মী বা রক্ষী। খেয়া মাঝি থেকে শুরু করে যাত্রী সকলেই আতঙ্কে থাকেন।সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়, সন্দেশখালি ২ নম্বর ব্লকের একমাত্র সরকারি হাসপাতাল – সন্দেশখালি গ্রামীণ হাসপাতাল – এই খুলনাতেই অবস্থিত। ফলে আতাপুর থেকে কারও যদি হঠাৎ গুরুতর অসুস্থতা হয় বা অ্যাক্সিডেন্ট হয়, তাকে সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছনো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। নৌকা চালাতে চালাতে মাঝ নদীতে রোগীর অবস্থার আরও অবনতি হয় — এমন উদাহরণ কম নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা সীমা পাত্র বলেন, “একদিন সন্ধ্যাবেলা আমার বাবার শরীর খারাপ হল। কিন্তু ঘাটে আলো নেই, নদীতে জল বেশি, ঘাট আবার কাদা। শেষমেশ রিক্সা ঠেলে এনে তুলে দিতে হয়। সেই অভিজ্ঞতা ভুলতে পারি না।” অপর একজন, রতন সর্দার বলেন, “যে হারে খেয়া ঘাটে যাত্রী বাড়ছে, তাতে জেটিঘাট না হলে বড় দুর্ঘটনা হবেই। আমরা তো রোজকার জীবনে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছি।”এমন সংকটময় অবস্থায় স্থানীয়রা বহুবার প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন সময়ে ব্লক অফিস, পঞ্চায়েত এবং সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদকে লিখিত ও মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে, তবে বাস্তবে কাজের অগ্রগতি চোখে পড়েনি। যদিও খুলনা অঞ্চলের প্রধান রিন্টু সান্যাল জানিয়েছেন, “সুন্দরবন পর্ষদকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই টেন্ডার প্রসেস চলছে এবং খুব শীঘ্রই জেটিঘাট নির্মাণের কাজ শুরু হবে।”বিশেষজ্ঞদের মতে, আতাপুর-খুলনা খেয়াঘাট সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষের জীবনে যোগাযোগের একমাত্র বাহন। যদি এখানে একটি আধুনিক কংক্রিট জেটি তৈরি করা হয়, তবে শুধু যাতায়াত নয় – ব্যবসা, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশাসনিক পরিষেবার ক্ষেত্রেও ব্যাপক সুবিধা হবে। সন্দেশখালির পরিবেশবিদ নীলরতন পাত্র বলেন, “সুন্দরবনের নদীগুলি এখন আর কেবল জল নয়, এই নদী মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মাধ্যম। তাই এই নদীপথে নিরাপত্তা না দিলে সেটা সরকারের চূড়ান্ত অবহেলার নিদর্শন।”একটি জেটিঘাট তৈরি মানেই শুধুমাত্র একটি পাথরের স্ট্রাকচার নয়, সেটা মানুষের বিশ্বাস, জীবনের নিরাপত্তা, পরিবারকে সময়মতো পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস। এই সময়ে যখন চারদিকে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, তখন আতাপুরের মতো গ্রাম এখনও ঝুঁকিপূর্ণ কাঠের সাঁকোয় দাঁড়িয়ে, তা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।

আতাপুর পঞ্চায়েত সদস্য চন্দনা হালদার বলেন, “আমরাও এই দাবির সঙ্গে একমত। জেটিঘাট ছাড়া আতাপুরের ভবিষ্যৎ নেই। মেয়েরা রাতে একা নদী পার হতে ভয় পায়, বাচ্চারা স্কুলে যেতে গিয়ে পড়ে যায়। আশা করছি এবার জেটি হবে।” প্রশাসনের তরফে যদি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দাবিকে সম্মান জানিয়ে সঠিক পরিকল্পনায় কাজ শুরু হয়, তাহলে আতাপুর-খুলনা খেয়াঘাট হতে পারে সুন্দরবনের উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।এখন দেখার বিষয়, জেটিঘাট নির্মাণ কত দ্রুত বাস্তবায়িত হয় এবং আতাপুরবাসী কবে আর “ভয়ে ভয়ে নদী পার হওয়ার গল্প” বন্ধ করে শান্তিতে যাতায়াত করতে পারেন।