Colorful procession arrives on New Year’s Eve : বাংলা নববর্ষ মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব, আর সেই উৎসবের রঙ যেন ছড়িয়ে পড়ল গোটা আসানসোল শহরে। সোমবার সকালটা যেন ছিল অন্যরকম এক উজ্জ্বল সকাল—আকাশে রোদের ঝলকানি, আর মাটিতে মানুষের ঢল। কারণ সেই দিনই অনুষ্ঠিত হল ‘বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে আসানসোলে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা’। এই শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল আসানসোল সংস্কৃতি মঞ্চ, আর সেই মঞ্চেরই উদ্যোগে গির্জা মোড় থেকে শুরু হয়ে রাহালেনের মিউনিসিপ্যাল পার্ক পর্যন্ত পায়ে হেঁটে মিছিল করে হাজারো মানুষ। শোভাযাত্রার আগে থেকেই গির্জা মোড় যেন রঙিন মেলার মাঠে পরিণত হয়, যেখানে ঢাকের বাদ্যি, বাউল গান, ছৌ নাচ, আদিবাসী নৃত্য, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, ঢোল-নাগাড়ার তালে পুরো এলাকা কেঁপে উঠেছিল। শুধু আসানসোল শহরের মানুষ নয়, আশেপাশের গ্রাম থেকেও বহু মানুষ এই উৎসবে অংশ নিতে চলে আসেন। অংশগ্রহণকারীরা সকলেই ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরে এসেছিলেন—পুরুষরা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, নারীরা শাড়ি পরে ফুলের গয়নায় সেজে উঠেছিলেন, যেন
নববর্ষের নিজস্ব এক রঙ ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। শোভাযাত্রার নেতৃত্বে ছিলেন রাজ্যের আইন ও শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক, যিনি বলেন, “এই ধরনের সাংস্কৃতিক উদ্যোগ আমাদের সমাজের ঐক্য ও সংস্কৃতির ধারাকে বাঁচিয়ে রাখে। আমরা চাই নতুন প্রজন্ম এগুলো থেকে শিক্ষা নিক, এবং শিকড়ের সঙ্গে আরও গভীরভাবে যুক্ত থাকুক।” তাঁর পাশে ছিলেন আসানসোল পৌরনিগমের দুই ডেপুটি মেয়র ওয়াসিমুল হক এবং অভিজিৎ ঘটক, যাঁরা জানান, “নববর্ষ মানেই মিলনমেলা, আর এই শোভাযাত্রা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমরা গর্বিত, আসানসোলের মানুষ এত আন্তরিকভাবে এই অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন।” পান্ডবেশ্বরের বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেন, “আদিবাসী সংস্কৃতি থেকে শুরু করে মূলধারার বাঙালি সংস্কৃতি—সবকিছুর মেলবন্ধন এই শোভাযাত্রা, যা সত্যিই অসাধারণ।” অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন আসানসোল পৌরনিগমের চেয়ারম্যান অমরনাথ চ্যাটার্জিও। তিনি বললেন, “এই ধরনের অনুষ্ঠান আসানসোল শহরের পরিচিতিকে রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে।” এই শোভাযাত্রায় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণও ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রার আদলে রঙিন ব্যানার, মুখোশ, পুতুল, পোস্টার নিয়ে হেঁটেছেন। কেউ মাটির সরায় ‘শুভ নববর্ষ’ লিখে হাতে নিয়ে চলেছেন, কেউবা আবার লোকনৃত্যের পোশাক পরে উৎসবের রঙে মিশে গেছেন। সব মিলিয়ে এই শোভাযাত্রা যেন ছিল এক চলমান মিউজিয়াম—যেখানে দেখা গেল বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর মানুষের মিলেমিশে একসাথে চলার এক অদ্ভুত সৌন্দর্য। শোভাযাত্রার পথজুড়ে সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ে হাততালি দিচ্ছিলেন, কেউ মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করছিলেন এই রঙিন মুহূর্ত, আবার কেউবা সন্তানকে কাঁধে বসিয়ে দেখাচ্ছিলেন “এটাই বাংলা নববর্ষ”। শুধু তাই নয়, আসানসোল সংস্কৃতি মঞ্চের সভাপতি শ্রী রথীন ভট্টাচার্য বলেন, “প্রতিবছরই আমরা এই শোভাযাত্রার আয়োজন করি, কিন্তু এবারের মতো এতটা সাড়া আগে কখনো পাইনি। মানুষ নিজের থেকেই অংশ নিচ্ছে, এটা আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া।” অনুষ্ঠানে একদিকে যেমন ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অন্যদিকে ছিল সামাজিক

বার্তা দেওয়ার চেষ্টাও—পরিবেশ রক্ষা, গাছ লাগানো, প্লাস্টিক বর্জনের মতো বিষয়গুলোর উপরেও ব্যানার-পোস্টার তুলে ধরা হয়। মঞ্চে বাউল গানের সঙ্গে আবৃত্তি, ছড়া, ছোট নাটকও উপস্থাপিত হয়, যা বিশেষ করে ছোটদের দারুণভাবে আকর্ষণ করে। আশ্চর্যজনকভাবে, শোভাযাত্রার সময় রাস্তায় যান চলাচলে কোনও বিশৃঙ্খলা হয়নি। ট্রাফিক পুলিশ ও সেচ্ছাসেবীরা একসাথে মিলিয়ে অত্যন্ত সুন্দরভাবে গোটা পরিস্থিতি সামলেছেন। শহরের বিভিন্ন মোড়ে ছিল পানীয় জল ও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা, যা মানুষের মধ্যে আরও স্বস্তি এনে দেয়। এই শোভাযাত্রার প্রভাব শুধু ওই দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না—সামাজিক মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান নিয়ে চর্চা শুরু হয়, হাজার হাজার ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, হ্যাশট্যাগে ভরে যায় টাইমলাইন। অনেকেই লেখেন, “এই হোক বাংলা নববর্ষের উদযাপন!” এই ধরনের অনুষ্ঠান ভবিষ্যতের প্রজন্মকে সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী করে তোলে। স্কুলপড়ুয়া অনন্যা ঘোষ বলে, “আমি আগে কখনও এভাবে নববর্ষ পালন করিনি, আজ মিছিলে হাঁটার পর মনে হচ্ছে আমি বাংলার একটা অংশ।” আরেক কলেজছাত্রী তৃষা রায় বলে, “এই শোভাযাত্রা শুধু আনন্দ নয়, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়।” এইভাবে বাংলা নববর্ষের দিন আসানসোল যেন হয়ে উঠল এক সংহতির উদাহরণ, এক সংস্কৃতির জাগরণ। ভবিষ্যতে এই ধরনের শোভাযাত্রা শহরের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে আরও দৃঢ় প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্য দিয়ে শুধু উৎসব নয়, মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, পারস্পরিক সহমর্মিতা এবং গর্বের এক অনুভব তৈরি হয়, যা কোনও রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে দাঁড়ায়। বাংলা নববর্ষের এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা এক কথায় আসানসোলের হৃদয়ে রঙ তুলির মতো আঁকা এক ইতিহাস হয়ে থাকবে।