China devastated by floods, death toll rises to at least 60 : ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে চিনের উত্তরাঞ্চলে চলতে থাকা বন্যা পরিস্থিতি। গত কয়েক দিনের টানা অঝোর বর্ষণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে একের পর এক এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে জলের নিচে। মানুষের জীবনের উপর নেমে এসেছে এক গভীর অনিশ্চয়তা। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, এই দুর্যোগে মৃতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই অন্তত ৬০-তে পৌঁছেছে, যার মধ্যে শুধু রাজধানী বেজিংয়েই মৃত্যু হয়েছে ৪৪ জনের। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির খবর মিলেছে বেজিংয়ের শহরতলিতে অবস্থিত একটি বৃদ্ধাবাস থেকে, যেখানে জলমগ্ন অবস্থায় অর্ধেকের বেশি বাসিন্দার প্রাণহানি ঘটেছে।
চিনের আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, বছরের এই সময়টায় বর্ষণ স্বাভাবিক হলেও এবারের পরিমাণ এবং ব্যাপ্তি সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। ২০১২ সালের জুলাই মাসে বন্যায় ৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল বেজিংয়ে, যা ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা, কিন্তু এবারের পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়ঙ্কর আকার নিচ্ছে বলেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। শুধুমাত্র মৃত্যুর সংখ্যা নয়, এই বন্যা চিনের পরিকাঠামোতেও গভীর চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত জানা গিয়েছে, ৩১টি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, বহু জায়গায় সেতু ভেসে গিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা।
প্রায় ১৩৬টি গ্রাম সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। হেবেই প্রদেশে এখনো পর্যন্ত ৩১ জন নিখোঁজ, যাঁদের খোঁজে দিনরাত এক করে চলছে উদ্ধার কাজ। হেলিকপ্টার নামানো হয়েছে দুর্গম এলাকায় আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারের জন্য। রাজপথে হেঁটে যাচ্ছে বৃদ্ধ ও শিশুদের দীর্ঘ মিছিল, যাঁরা তাঁদের শেষ সম্বলটুকুও হারিয়ে ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি নদীগুলি ফুলেফেঁপে উঠেছে, যার ফলে অনেক গ্রামে হঠাৎ করে বন্যা ঢুকে পড়েছে গভীর রাতে, এবং মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন। চিনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এই পরিস্থিতিকে “জাতীয় দুর্যোগ” বলে আখ্যা দিয়ে ইতিমধ্যেই সমস্ত জরুরি বিভাগকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
দমকল, সেনাবাহিনী, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী সবাই একযোগে কাজ করছে। তবে এই বিপর্যয়ের মূল কারণ হিসেবে আবহাওয়াবিদরা জলবায়ু পরিবর্তনের দিকেই আঙুল তুলছেন। টানা এবং ঘনঘন বৃষ্টিপাত, হঠাৎ বন্যা, এবং আগের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতির পেছনে মূলত দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং নদী-নালার দখল বলেই মত তাঁদের। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, “আগে এমন হয়নি, এই বৃষ্টিতে এমন ভয় দেখায়নি আমাদের শহরকে। এবার যেন প্রকৃতি রাগে ফেটে পড়েছে।” এক মহিলা ত্রাণ শিবিরে বসে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমার স্বামী জলে পড়ে গিয়েছিলেন রাতে, ওনাকে এখনও খুঁজে পাইনি, বাড়ি সব ভেসে গেছে, আর কিছুই নেই।” এমন হৃদয়বিদারক ছবি এখন গোটা চিন জুড়ে। চিনের সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস এবং চায়না ডেইলির রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশজুড়ে প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষ এই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। স্কুল-কলেজ, অফিস, বাজার সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু জেলায়।
বহু এলাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন। এদিকে চিনা সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে দ্রুতগতিতে। প্রতিটি জেলায় চাল, জল, ওষুধ পাঠানো হয়েছে। তবে বৃষ্টির কারণে ত্রাণ পৌঁছানোও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সাহায্যেরও আবেদন জানানো হয়েছে জাতিসংঘের কাছে। জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টেফান ডুজারিক এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা চিনের পাশে আছি, মানুষকে সহায়তা পৌঁছে দিতে প্রস্তুত। পরিবেশের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য আমাদের এখনই পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।” প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে এবার চিন সরকার বুঝতে পারছে, শুধু আধুনিক পরিকাঠামো নয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিস্থিতির প্রভাব শুধু চিনের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ থাকবে না, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, রপ্তানি, এমনকি কৃষিপণ্য সরবরাহেও প্রভাব পড়বে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। বিশেষ করে চীনের উত্তর-পূর্ব অংশে কৃষিজমির বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যার ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে মানব সভ্যতা কতটা অরক্ষিত। এবং উন্নত প্রযুক্তির জগতে দাঁড়িয়ে আজও মানুষ প্রকৃতির কাছে কতটা অসহায়।