China devastated by a terrible storm : চিনের উত্তরাঞ্চলে এক ভয়ঙ্কর ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়েছে গত কয়েকদিন ধরে, যার অভিঘাতে দেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শহর কার্যত স্তব্ধ হয়ে গেছে। সবচেয়ে বিপর্যস্ত বেজিং শহর, যেখানে ঝড়ের কারণে এতটাই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে প্রশাসন পর্যন্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে – যাঁদের ওজন ৫০ কেজির নিচে, তাঁরা যেন ঘর থেকে না বেরোন, কারণ এমন হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে যাবার সম্ভাবনাও কম নয়! এমন সতর্কতা এক দশকে এই প্রথম। ১০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বেজিংয়ে জারি করা হয়েছে ‘কমলা সতর্কতা’, যা চিনের চার স্তরের ঝড় সতর্কতা ব্যবস্থার দ্বিতীয় স্তর এবং খুবই সংকটজনক পরিস্থিতির সংকেত বহন করে। চিনের জাতীয় আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, এবারের এপ্রিল মাসটি হতে চলেছে ১৯৫১ সালের পর সবচেয়ে বেশি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। ঝড় এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে ইতিমধ্যেই বেজিংয়ের আকাশপথ সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত হয়েছে – বাতিল হয়েছে প্রায় ৪০০টি ফ্লাইট, আর যাত্রীদের অসহায়ভাবে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে বিমানবন্দরগুলিতে। শুধু তাই নয়, বাতাসের তীব্রতায় বেজিংয়ের রাস্তায় প্রচুর গাছ উপড়ে পড়েছে, গাছের উপর ভেঙে পড়ে অসংখ্য গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন থেকে জানানো হয়েছে যে, ঝড় আসার আগেই প্রায় ৪৮০০টি গাছ ছেঁটে দেওয়া হয়েছিল ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য, কিন্তু তাতেও বিশেষ লাভ হয়নি।

এদিকে, শুধু বেজিং নয় – এই ঝড়ের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে মঙ্গোলিয়া, হেনান, হেইলংজিয়াং, সাংহাই প্রভৃতি চিনের বহু গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে। সাংহাইয়ে ইতিমধ্যেই ধুলোঝড়ের সতর্কতা জারি করা হয়েছে, আর সাধারণ মানুষকে জরুরি প্রয়োজনে ছাড়া বাইরে না বেরোনোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চিনের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, হেনানে ঝড়ের জেরে কিছু জায়গায় বিদ্যুৎ পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে, রাস্তা ভেঙে গিয়েছে, বহু মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। স্কুল-কলেজ থেকে অফিস – প্রায় সব জায়গাতেই উপস্থিতির হার কমে এসেছে চোখে পড়ার মতো। এমন এক পরিস্থিতিতে জনজীবন কীভাবে এগোবে – সেটাই এখন চিনা নাগরিকদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
চিনের বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ঝাও মিং বলেন, “এটি একটি বিরল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় ৮০ কিমি ছাড়িয়ে গেছে, যা সাধারণ শহুরে পরিকাঠামোর জন্য বিপজ্জনক। এই পরিস্থিতি শুধু বর্তমান ক্ষয়ক্ষতি নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য বড় একটি সতর্কবার্তা। শহরের গাছপালা, বৈদ্যুতিক লাইন, গাড়ি, মানুষ – সব কিছুই ঝুঁকির মধ্যে।” সাধারণ মানুষও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। বেজিংয়ের বাসিন্দা উই লি, যিনি একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করেন, তিনি বলেন, “এত বড় ঝড় আমি জীবনে কখনও দেখিনি। আমরা এখন দিনের পর দিন ঘরেই আছি, শুধু দরকার হলে খাবার আনতে বেরচ্ছি। এমনকী, আমার বাচ্চার স্কুলও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।”
চিনের প্রশাসন যদিও দ্রুত ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। শহরজুড়ে জরুরি পরিষেবার দল মোতায়েন করা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন প্রতিটি এলাকায় সতর্কতা প্রচার করছে, সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আপডেট দেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ভুগতে থাকা এলাকাগুলিতে দ্রুত মেরামতির কাজ চলছে। তবে, এত কিছুর মাঝেও চিন্তা থেকেই যাচ্ছে – এই ঝড় যদি আরও কিছুদিন ধরে চলে, তবে অর্থনীতি এবং সমাজজীবনে আরও বড় প্রভাব পড়বে।
চিনের অর্থনীতিবিদ লি জু জানিয়েছেন, “চিনের মতো শিল্পনির্ভর দেশে এমন কোনো ঝড় যা পরিবহন, উৎপাদন ও পরিষেবা খাতে প্রভাব ফেলে, তা দেশীয় উৎপাদনের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। গত তিন বছরে কোভিডের ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই প্রকৃতির এই মার যেন আবার একটা বড় আঘাত।” তবে তিনি আশাবাদী যে, সঠিক পরিকল্পনা থাকলে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, আগামী কয়েকদিন ঝড় কিছুটা প্রশমিত হলেও, বিক্ষিপ্তভাবে ঝড়ো হাওয়া, ধুলোঝড় এবং গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়ে যাবে চিনের পূর্ব এবং উত্তরাঞ্চলে। বিশেষ করে সাংহাই ও হেইলংজিয়াং অঞ্চলে বাসিন্দাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে – জানালা ভালোভাবে বন্ধ করে রাখা, বাইরে বেরোলেও মুখ ঢেকে রাখা, এবং ছোট বাচ্চা ও বয়স্কদের সম্পূর্ণভাবে ঘরে রাখতে।
চিনের এই পরিস্থিতি গোটা বিশ্বের কাছেই বড় একটি উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কতটা আকস্মিক এবং কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে। ভবিষ্যতের জন্য শহরগুলিকে আরও টেকসই এবং দুর্যোগ-প্রতিরোধী করে গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবি। তবেই বাঁচানো যাবে জনজীবন, সম্পদ এবং মনোবল। এই ভয়াবহ ঝড় চিনের জন্য যেমন শিক্ষা, তেমনি গোটা পৃথিবীর শহরগুলোর জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা – প্রকৃতির রুদ্ররূপকে অবহেলা করলে, তার প্রতিশোধ বড়ই নির্মম হতে পারে।