Chance of thunderstorms in various districts:সোমবার সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ করে নেমে আসা ঝমঝমে বৃষ্টি যেন রাজ্যবাসীর মনে খানিকটা স্বস্তি এনে দিয়েছিল, শহর কলকাতা থেকে শুরু করে নদিয়া, হুগলি, হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন অংশে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে বেশ ঠান্ডা হয়ে উঠেছিল পরিবেশ। কিন্তু সেই স্বস্তি স্থায়ী হল না। মঙ্গলবার সকাল হতেই ফের ফিরে এল চেনা রূপ—কড়া রোদ, দাহ্য গরম, রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মানুষের মুখে জল। সবাই এখন একটাই প্রশ্ন করে চলেছেন—”আচ্ছা, বর্ষা কবে আসবে?” আবহাওয়া দফতরের তরফে এই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা হলেও মিলেছে। হাওয়া অফিস জানাচ্ছে, ভারতের মূল ভূখণ্ডে বর্ষা প্রবেশের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে, ইতিমধ্যেই আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বর্ষা ঢুকে পড়েছে। দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর, আন্দামান সাগর ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ওপর দিয়ে শক্তিশালী পশ্চিমী বাতাস বইছে, যা বর্ষা আগমনের স্পষ্ট ইঙ্গিত। এই পরিস্থিতি বজায় থাকলে আগামী তিন থেকে চার দিনের মধ্যে মধ্য বঙ্গোপসাগরেও ঢুকে পড়বে বর্ষা। কেরালায় বর্ষা আসার সম্ভাব্য দিন নির্ধারিত হয়েছে ২৭ মে, যা দেশের মূল ভূখণ্ডে বর্ষা প্রবেশের আনুষ্ঠানিক সূচনা বলে মনে করা হয়।
তবে বঙ্গে? পশ্চিমবঙ্গে বর্ষা ঢুকতে ঢুকতে লাগবে আরও সময়। আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, জুনের প্রথম সপ্তাহেই গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বর্ষার প্রবেশ ঘটতে পারে। অর্থাৎ গরমের এই দুর্বিষহ দিন আরও অন্তত ১৫ দিন ভোগাবে। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে ইতিমধ্যেই তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। রাজ্যের কৃষক সমাজের মধ্যে এই দেরিতে বর্ষা নিয়ে তৈরি হয়েছে চিন্তার ভাঁজ। নদিয়া জেলার কৃষক মদন বিশ্বাস জানাচ্ছেন, “আমরা আষাঢ়ের প্রথম বর্ষার জলেই বীজ রোপণের কাজ শুরু করি। যদি বৃষ্টি না আসে, ফসল বপনের কাজ আটকে যাবে। তাতে চাষের মৌসুমও পিছিয়ে যাবে।” তাঁর মতো অনেক কৃষকেরই এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে দিন কাটছে।
কলকাতা শহরে তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছে। বেলেঘাটা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক ডঃ সুদীপ দে জানাচ্ছেন, “এই তাপপ্রবাহে হিট স্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, হাইপার টেনশনের সমস্যা বাড়ছে। গত তিন দিনে অন্তত ৪৫ জন রোগীকে হিট এক্সহসশনের কারণে ভর্তি করতে হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “বর্ষা এলেই এমন পরিস্থিতির উন্নতি হবে, কিন্তু তার আগে সবাইকে সাবধান থাকতে হবে।”
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ অনিন্দ্য মুখার্জি জানিয়েছেন, “বর্ষা পৌঁছাতে গেলে একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড পূরণ করতে হয়—বাতাসে জলীয় বাষ্পের মাত্রা, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তা এবং নিম্নচাপ তৈরি হওয়া। এখনই তা আন্দামান অঞ্চলে দেখা গেলেও মূল ভূখণ্ডে পৌঁছাতে আরও সময় লাগবে।” তিনি আরও জানান, “বঙ্গোপসাগরের মাঝ বরাবর একটা সক্রিয় ঘূর্ণি তৈরি হলে বর্ষা আরও দ্রুত এগোতে পারে, তবে তেমন কোনও আশার আলো এখনো নেই।”
এর মধ্যেই আশার খবর—তাপমাত্রা বেড়ে চললেও উত্তরবঙ্গের কিছু অংশে প্রাক-বর্ষার বৃষ্টি শুরু হতে পারে। দার্জিলিং, কালিম্পং ও জলপাইগুড়িতে এই সপ্তাহেই হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও দক্ষিণবঙ্গে সেই আশার বৃষ্টি এখনও দূর অস্ত।
স্কুল-কলেজগুলিতে ছুটির সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে দুপুরের পর ক্লাস বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি করেছে রাজ্য শিক্ষা দপ্তর। বেহালার বাসিন্দা গৃহবধূ শ্রীমতী প্রতিমা মুখার্জি জানাচ্ছেন, “ঘর ঠান্ডা রাখতে বারবার জল ছিটাচ্ছি, ছাদে জল দিচ্ছি, তবুও বাচ্চাদের পড়তে বসানো যাচ্ছে না। গরমে মাথা ধরে যাচ্ছে। বৃষ্টি না এলে যেন নাজেহাল অবস্থা।”
সব মিলিয়ে, রাজ্যবাসী এখন বর্ষার জন্য একরকম দিন গুনছে। প্রকৃতি যেন বর্ষার আগমনের সুর শোনাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির জলে শান্তি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা আরও দীর্ঘতর হবে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। তবে সতর্কতা মেনে চললেই এই গরম সাময়িক হলেও মোকাবিলা করা সম্ভব। টানা গরমের এই পরিস্থিতিতে জল খাওয়ার পরিমাণ বাড়ানো, বাইরে বেরোনোর সময় ছাতা ব্যবহার এবং শিশু ও বৃদ্ধদের বাড়ির বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এই অবস্থায় বর্ষা শুধু একটি ঋতুই নয়, একরকম মুক্তি, একরকম প্রার্থনার নাম হয়ে উঠেছে। সবকিছু মিলিয়ে রাজ্যবাসীর এখন একটাই অপেক্ষা—“বৃষ্টি কবে নামবে?”