Saturday, October 11, 2025
Google search engine
HomeDurgapujaমুর্শিদাবাদে প্রাচীন রীতি মেনে নৌকা বাইচে ‘বুড়িমার’ বিসর্জন

মুর্শিদাবাদে প্রাচীন রীতি মেনে নৌকা বাইচে ‘বুড়িমার’ বিসর্জন

‘Burimar’ immersed in boat in Murshidabad following ancient rituals: বাংলার উৎসব মানেই রঙ, আবেগ আর ঐতিহ্যের মেলবন্ধন। দুর্গাপুজোর শেষে প্রতিমা বিসর্জন শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং তা এক গভীর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতিফলন। মুর্শিদাবাদের ডোমকল মহকুমার অন্তর্গত জিতপুর গ্রাম বহু শতাব্দী ধরে এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছে। তিন শতাধিক বছরের পুরনো এই ‘বুড়িমা পুজো’ আজও গ্রামের মানুষের মনে গভীর আবেগ জাগায়। দুর্গাপূজার সমাপ্তি এখানে শুধুমাত্র বিদায় নয়—এ যেন এক মহোৎসব, যেখানে মিলেমিশে যায় ভক্তি, উৎসব ও লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য।শুক্রবার রাতে জিতপুর গ্রাম সাক্ষী থাকল এক অনন্য দৃশ্যের। শতাব্দীপ্রাচীন রীতি মেনে এদিন ভৈরব নদীর জলে অনুষ্ঠিত হল দেবী দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন। কিন্তু এই বিসর্জনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল নৌকা বাইচ—এক অনন্য প্রতিযোগিতা, যা শুধু ক্রীড়া নয়, বরং সংস্কৃতিরও প্রতীক।


বুড়িমা নামে পরিচিত গ্রামের প্রধান প্রতিমাকে সযত্নে সাজানো নৌকায় তোলা হয়। সেই সঙ্গে গ্রামের আরও কয়েকটি প্রতিমাকেও রাখা হয় একে একে নৌকাগুলিতে। তারপর শুরু হয় নদীর বুকে রোমাঞ্চকর নৌকা বাইচ। নদীর দুই তীরে তখন হাজারো মানুষ—কেউ ঢাক বাজাচ্ছেন, কেউ শঙ্খধ্বনি তুলছেন, কেউবা মশালের আলোয় নদীর বুক আলোকিত করছেন।ভৈরব নদীর দুই পারে জনসমুদ্র, উল্লাসে ভরা মুখ, আর দেবীর বিদায়ের বেদনাময় হাসি—সব মিলিয়ে এক মায়াময় সন্ধ্যা। নদীর জলে প্রতিফলিত আলো, আতশবাজির ঝলকানি, আর ঢাকের আওয়াজে মুখরিত হয়ে ওঠে সমগ্র অঞ্চল।

Screenshot 2025 10 04 165355

এই বিশাল ভিড় সামলাতে প্রশাসন ছিল তৎপর। ডোমকল থানার উদ্যোগে পুরো বিসর্জন পর্বে ছিল কড়া পুলিশি নজরদারি। নদীর ঘাট ও আশেপাশের এলাকায় মোতায়েন ছিল পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে—“প্রতি বছর এই অনুষ্ঠান ঘিরে ব্যাপক জনসমাগম হয়, তাই নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো ঢিলেমি রাখা হয়নি।”এছাড়াও, স্থানীয় পঞ্চায়েত ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিও নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তাদের সহায়তায় নদীর ঘাটে আলোর ব্যবস্থা, অস্থায়ী শৌচালয় এবং চিকিৎসা সহায়তাও রাখা হয়েছিল।

Screenshot 2025 10 04 165520

গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা রতন ঘোষ বললেন, “আমাদের বুড়িমা শুধু দেবী নন, তিনি জিতপুরের প্রাণ। ছোটবেলা থেকে এই নৌকা বাইচ দেখছি, কিন্তু প্রতি বছর যেন নতুন করে রোমাঞ্চ হয়।”অন্যদিকে, প্রতিবেশী নদীয়া জেলা থেকে আসা দর্শনার্থী নীতা পাল বলেন, “এমন বিসর্জন আমি আগে কখনও দেখিনি। নৌকা বাইচের সঙ্গে দেবীর বিদায় যেন বাংলার ঐতিহ্যের সেরা রূপ।”স্থানীয় যুবকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ছিল তুঙ্গে। তারা নিজেরাই নৌকা সাজানোর দায়িত্ব নেয়, আরতি করে, ও নদীর বুকে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এই উৎসব যেন একসঙ্গে মিলিয়ে দেয় সব বয়স, সব শ্রেণির মানুষকে।

Screenshot 2025 10 04 165628

এই ধরনের ঐতিহ্যবাহী উৎসব শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক বন্ধনকেও দৃঢ় করে। নৌকা বাইচ এখানে প্রতিমা নিরঞ্জনের অংশ হিসেবে সংস্কৃতির ধারক হয়ে উঠেছে।
মুর্শিদাবাদের মতো ঐতিহ্যবাহী জেলায় এমন উৎসব স্থানীয় অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে। বহু দর্শনার্থী এদিন গ্রামে ভিড় জমায়, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বিক্রির সুযোগ পান, গ্রামীণ পর্যটনও উৎসাহ পায়।সাংস্কৃতিক গবেষক তন্ময় হালদার বলেন, “বুড়িমা বিসর্জন শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি এক ‘living heritage’—যেখানে পুরনো রীতির সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রা ও আবেগ জড়িয়ে আছে।”এই উৎসব প্রমাণ করে, আধুনিকতার ভিড়েও গ্রামীণ বাংলা এখনো তার শিকড় আঁকড়ে ধরে আছে।

Screenshot 2025 10 04 165729

জিতপুরবাসীরা চান এই ঐতিহ্য রাজ্য পর্যায়ে স্বীকৃতি পাক। স্থানীয় ক্লাব ও পঞ্চায়েত যৌথভাবে উদ্যোগ নিচ্ছে যাতে আগামী বছর থেকে এই উৎসবকে “গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে তুলে ধরা যায়।এছাড়া, প্রশাসনও ভাবছে উৎসবকে আরও সুরক্ষিত ও পরিবেশবান্ধব করার দিকে—যেমন নদী দূষণ রোধে পরিবেশবান্ধব প্রতিমা ব্যবহার, এবং প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা।দুর্গাপূজার সমাপ্তি মানে শুধু দেবীর বিদায় নয়, মানুষের মিলনও।

Screenshot 2025 10 04 165816

জিতপুরের বুড়িমা বিসর্জন সেই মিলনেরই প্রতীক—যেখানে নৌকার বৈঠায় ভক্তির ছোঁয়া, নদীর জলে প্রতিফলিত আলোর মতোই ঝলমল করে ওঠে মানুষের ঐক্য ও সংস্কৃতি।এই প্রাচীন ঐতিহ্য যেন চিরকাল টিকে থাকে—ভৈরবের জলে, জিতপুরের মনে, আর বাংলার হৃদয়ে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments