Boeing Dreamliner in trouble again : গত শুক্রবারের সেই রাতটা যেন সিনেমার এক উত্তেজনাপূর্ণ দৃশ্য—কিন্তু তা বাস্তবেই ঘটেছে মাঝআকাশে, আমেরিকার ওয়াশিংটন থেকে উড়ে যাওয়া ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনারে। ফের একবার প্রশ্নের মুখে এই বহুল সমালোচিত বোয়িং ড্রিমলাইনার, যার নাম শুনলেই এখন যাত্রীদের মনে এক অজানা আতঙ্ক জন্ম নেয়। শুক্রবার সন্ধ্যায় ডালস বিমানবন্দর থেকে মিউনিখের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল এই যাত্রীবাহী বিমানটি, যার অভ্যন্তরে ছিল ১৬৭ জন যাত্রী ও ১১ জন কর্মী। উড়ানের কিছুক্ষণের মধ্যেই, প্রায় ৫ হাজার ফুট উচ্চতায় পৌঁছে হঠাৎ বিকল হয়ে পড়ে বিমানটির বাঁদিকের ইঞ্জিন। সেই মুহূর্তে ককপিটের ভিতর দমবন্ধ করা এক চাপা টানটান উত্তেজনা, সঙ্গে সঙ্গে পাইলট ককপিট থেকে ‘মে-ডে’ কল পাঠান—আন্তর্জাতিক ভাষায় যা সর্বোচ্চ বিপদের সংকেত হিসেবে ধরা হয়। বিমানটি তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করে ওয়াশিংটনের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে, আর এক মুহূর্তও দেরি না করে নির্দেশ চেয়ে নেয় জরুরি অবতরণের। তবে, অবতরণের অনুমতি পেতে পেতে বিমানটি প্রায় ২ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট ঘুরপাক খেয়েছে ওয়াশিংটনের আকাশে।
এই সময়টুকু যেন প্রতিটি যাত্রীর জীবনের সবচেয়ে আতঙ্কের মুহূর্ত হয়ে রইল—মাঝআকাশে বিপদ, হঠাৎ ইঞ্জিন বিকল, ভিতরে স্নায়ুর চাপ আর তীব্র আতঙ্ক। অনেকে বলেন, প্লেনের জানালা দিয়ে তারা নিচে ঝকঝকে আলোকিত শহরের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুর ছায়া কল্পনা করছিলেন। যাত্রীদের একাংশ জানান, “বিমানে আচমকা একটা বিকট শব্দ শুনতে পাই, তারপর তীব্র ঝাঁকুনি। আমরা বুঝে যাই কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে।” আরেক যাত্রী বলেন, “আমার পাশে বসে থাকা এক মহিলার হাত আমি ধরে রেখেছিলাম পুরো সময়, আমরা শুধু প্রার্থনা করছিলাম যেন বেঁচে ফিরতে পারি।”

শেষ পর্যন্ত, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পর সফলভাবে জরুরি অবতরণ করে বিমানটি ডালস বিমানবন্দরে। কিন্তু এই ঘটনার পরে ফের একবার প্রশ্ন উঠেছে বোয়িং ড্রিমলাইনারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। এই একই ধরনের বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার গত এক বছরে একাধিকবার বিভ্রাটে পড়েছে, কখনও মাঝআকাশে দরজা খুলে যাওয়া, কখনও পাখা ভেঙে পড়া, কখনও রানওয়ে থেকে ছিটকে যাওয়া। উল্লেখযোগ্য, চলতি বছরই নিউইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি বোয়িং ৭৮৭ বিমানের জানালার কাঁচ খুলে গিয়েছিল মাঝআকাশে। এইসব ঘটনার পর যাত্রীদের মধ্যে একটি ভয় কাজ করছে, বিশেষ করে যারা নিয়মিত আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে যাতায়াত করেন। ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র জানিয়েছেন, “আমরা অত্যন্ত দুঃখিত এই ঘটনার জন্য। আমাদের পাইলট ও ক্রু সদস্যরা দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন এবং যাত্রীদের নিরাপদে ফিরিয়ে এনেছেন।
ইঞ্জিন বিভ্রাটের কারণ জানতে আমরা তদন্ত শুরু করেছি এবং বোয়িং কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে।” অন্যদিকে, বোয়িং কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “আমরা ঘটনাটি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছি এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সকে দেওয়া হচ্ছে।” তবে, সমালোচকরা বলছেন, শুধু প্রযুক্তিগত সহায়তা নয়, বরং বোয়িং-এর উচিত তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে কোথায় গলদ হচ্ছে তা খুঁজে বার করা এবং ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য কড়া পদক্ষেপ নেওয়া। মার্কিন ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FAA) ইতিমধ্যেই এই ঘটনার তদন্তে নেমেছে এবং বোয়িং ৭৮৭ সিরিজের আরও বেশ কয়েকটি বিমানের রুটিন ইঞ্জিন চেকিং শুরু করেছে। এই ধরণের ঘনঘন বিভ্রাট একদিকে যেমন যাত্রী নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলে, অন্যদিকে বোয়িং-এর বিশ্বব্যাপী বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দেয়।

এক সময় বিশ্বের অন্যতম নির্ভরযোগ্য এয়ারক্রাফট ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত বোয়িং, আজ সেই একই সংস্থার নাম শুনলে যাত্রীরা বুক কাঁপান। বিশেষজ্ঞদের মতে, “বর্তমানে বোয়িং ড্রিমলাইনারের বেশ কিছু প্রযুক্তিগত ত্রুটি স্পষ্ট হচ্ছে, যেগুলি আগে হয়তো চাপা পড়ে যেত। এবার FAA, NASA ও আন্তর্জাতিক এভিয়েশন বোর্ডগুলিকে একসঙ্গে বসে নতুন করে প্রযুক্তিগত নিরাপত্তার মান নির্ধারণ করতে হবে।” স্থানীয় মানুষেরা এই ঘটনায় খুবই বিচলিত, কারণ ওয়াশিংটনের আকাশে ২ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট ধরে একটি যান্ত্রিক বিভ্রাটগ্রস্ত বিমান ঘোরাফেরা করছিল, যা যেকোনও বড় বিপদের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারত। একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “আমরা জানতাম না ওপর থেকে কোনও বিপদ আমাদের মাথার ওপরেই ঘুরছে। পরে খবরের মাধ্যমে জানতে পারি, কী ভয়ানক পরিস্থিতি ছিল।”
এই ঘটনায় এমন এক বার্তা বহন করছে যা গোটা বিশ্বজুড়ে বিমান যাত্রীদের আশঙ্কা আরও বাড়াবে। প্রত্যেকবার দুর্ঘটনার পর তদন্ত হয়, বোয়িং ক্ষমা চায়, নিরাপত্তা খতিয়ে দেখা হয়, কিছুদিন আলোচনার পর আবার সব আগের মতো হয়ে যায়। কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে যে প্রশ্নগুলো উঠছে, তা আর চুপ করে রাখার সময় নেই। এই ঘটনার আলোকে যাত্রীদের জন্য আরও শক্তপোক্ত, আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তির দাবি উঠছে। আর যাত্রীদেরও জানা দরকার, তাদের জীবন নিয়ে কোনও কোম্পানি যেন আর কোনওরকম ঝুঁকি না নেয়। এই ঘটনাই যেন বোয়িং-এর জন্য এক সাবধানবাণী হয়—আর যেন না হয় “ফের বিপত্তি বোয়িং ড্রিমলাইনারে।