Boat stuck in Ajay River, 16 rescued শুক্রবার রাতের গা ছমছমে অন্ধকার আর অজয় নদে গর্জন তোলা স্রোত যেন একসঙ্গে মিলেমিশে তৈরি করেছিল এক চরম আতঙ্কের পরিবেশ। বীরভূম থেকে জামুরিয়ার সিদ্ধপুর-বাগডিহা ঘাটের দিকে যাত্রী নিয়ে রওনা হওয়া একটি নৌকা মাঝপথে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ায় অজয় নদের বুকে। ঘনিয়ে আসে অজানা আশঙ্কা, কারণ ওই নৌকাটির ইঞ্জিন আচমকাই বিকল হয়ে পড়ে। ঘটনার সময় রাত প্রায় আটটা। যাত্রীদের উদ্দেশ্য ছিল স্রেফ নদী পার হওয়া, কিন্তু প্রকৃতির খামখেয়াল তাদের ডুবিয়ে দেয় গভীর সঙ্কটে। অজয় নদের পানীয় জল প্রকল্পের পাইপলাইনের কাছেই নৌকাটি আটকে পড়ে যায়। ভয়ানক স্রোতের তোড়ে যেকোনও মুহূর্তে নৌকা উলটে যেতে পারে — এই আশঙ্কায় যাত্রীদের মধ্যে শুরু হয় চিৎকার, কান্নাকাটি, আতঙ্ক আর প্রার্থনার মিশেল। কেউ ফোনে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন, কেউ আবার ঈশ্বরের নাম মুখে জপতে থাকেন।
স্থানীয় বাসিন্দা শিবু সাঁতরা বলেন, “এই নদী আমরা চিনি। ওর যখন রাগ হয়, তখন কিচ্ছু মানে না। এই সময়টা আবার বৃষ্টির মরসুম, তাই জল বেড়েছে। আমরা বুঝতে পারছিলাম, কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। নৌকাটা দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ ধরে। তখনই আমরা খবর দিই পুলিশ ও সিভিল ডিফেন্সকে।”

সেই খবর পাওয়া মাত্রই তৎপর হয় প্রশাসন। বীরভূম ও জামুরিয়া প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে তৎক্ষণাৎ নামানো হয় সিভিল ডিফেন্সের একটি উদ্ধারকারী দল। ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সময় লাগে কিছুটা, কারণ নদীর দুই পারে পৌঁছানো সহজ ছিল না। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলস্তরও বাড়তে থাকে, সঙ্গে নদীর স্রোতও আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। অন্ধকারের মধ্যে উদ্ধার কাজ চালানো অত্যন্ত বিপজ্জনক হলেও দমকল ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েন। মোবাইল টর্চ, মাথায় হেলমেট, লাইফ জ্যাকেট— এসব সামগ্রী নিয়েই তাঁরা ধীরে ধীরে পৌঁছান আটকে পড়া নৌকার কাছাকাছি।
উদ্ধার কাজে যুক্ত সিভিল ডিফেন্স কর্মী রাজু ঘোষ জানান, “স্রোত এতটাই ছিল যে আমাদের নৌকাও এক সময়ে নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছিল। তবে ধীরে ধীরে আমরা পরিস্থিতি সামাল দিই। অনেকেই কেঁদে ফেলেছিলেন, ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। আমরা তাঁদের বোঝাই, সাহস দিই। রাত প্রায় চারটে নাগাদ আমরা শেষ যাত্রীটিকেও উদ্ধার করতে পারি। ভগবানের কৃপায় কেউ আহত হননি।”
উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন মহিলা, বৃদ্ধ এবং শিশুরাও। তাঁদের অনেকেই নদীর মাঝে এতক্ষণ আটকে থেকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন। নদীর ধারে রাখা হয়েছিল অ্যাম্বুলেন্স ও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা। উদ্ধার হওয়ার পর প্রত্যেককে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে রাখা হয় এবং কাউন্সেলিং দেওয়া হয় আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে।
একজন মহিলা যাত্রী, লিপিকা হালদার বলেন, “ভেবেছিলাম আজ আর বাড়ি ফিরতে পারব না। ভেতরটা থরথর করছিল। ছোট বাচ্চাটা আমার কোলে কাঁদছিল। এতক্ষণ পর যখন উদ্ধারকর্মীরা এল, তখন মনে হল যেন নতুন জীবন পেলাম।”
এই ঘটনাটি আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল রাজ্যের বিভিন্ন নদীতে নৌকা পারাপারে নিরাপত্তার ঘাটতি ঠিক কতটা। পুরনো ও রক্ষণাবেক্ষণহীন ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলি যে যেকোনও সময় বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে, তার প্রমাণ মিলল শুক্রবার রাতেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের যাত্রীবাহী নৌকাগুলিতে নিয়মিত ইঞ্জিন পরীক্ষা, জরুরি জীবনরক্ষাকারী সামগ্রী থাকা, ও চালকের ট্রেনিং থাকা অত্যাবশ্যক।
জামুরিয়া ব্লকের বিডিও অরিন্দম রায় জানিয়েছেন, “আমরা ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে দেখছি। সংশ্লিষ্ট নৌকাটি রেজিস্টার্ড কিনা, লাইসেন্স রয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দোষী প্রমাণিত হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে আমরা স্থানীয় নৌ চলাচলে নিরাপত্তা বাড়ানোর ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছি।”
রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের এক আধিকারিক বলেন, “পানীয় জলের পাইপলাইনের এলাকায় যাত্রীবাহী নৌকাচালনা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়েও আমরা রিপোর্ট তৈরি করছি। স্থানীয় প্রশাসনকে এই নিয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, দিনের আলোয় ও প্রশিক্ষিত চালকের হাতেই শুধু যাত্রী পরিবহণ হওয়া উচিত। নইলে কোনওদিন আবারও ঘটতে পারে একইরকম বিপর্যয়। নদীপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই সিসিটিভি নজরদারি, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষিত চালক-সাহায্যকারী দল।
পরিস্থিতি আপাতত স্বাভাবিক হলেও আতঙ্ক রয়ে গেছে মানুষের মনে। ঘটনার জেরে শনিবার ওই রুটে নৌকা চলাচল বন্ধ রাখা হয়। তদন্তের স্বার্থে নৌকাটিকে তীরে তুলে এনে পরীক্ষা করা হয়েছে। ইঞ্জিনটি দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করার কারণে জলে ঘোলা হয়ে পড়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শুধুমাত্র সড়ক বা রেলপথ নয়, নদীপথেও নিরাপত্তা এবং সময়োপযোগী প্রযুক্তির প্রয়োগ একান্ত প্রয়োজন। নইলে অজানা আতঙ্ক মাঝরাতে আবারও গ্রাস করবে নিরীহ মানুষকে।