Big blow to Tata Steel workers, 1600 employees set to lose jobs : গত সপ্তাহে টাটা স্টিল নেদারল্যান্ডস যে ঘোষণা করল, তা যেন একেবারে বজ্রাঘাতের মতো আঘাত হানল হাজার হাজার কর্মী ও তাদের পরিবারের জীবনে—প্রায় ১,৬০০ কর্মী চাকরি হারাতে চলেছেন! এমন ঘোষণা শুধু এক-একটি পরিবার নয়, গোটা একটি সমাজকে কাঁপিয়ে দিতে পারে, আর সেই কাঁপন ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে স্থানীয় জনজীবনে, ট্রেড ইউনিয়নে এবং বিশ্বজুড়ে কর্মজীবী মানুষদের মনে। টাটা স্টিল নেদারল্যান্ডসের মুখ্য নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক টি ভি নরেন্দ্রন বলেছেন, “এই রদবদল ভবিষ্যতের দিকে এগোনোর জন্য একটি সোপান। আমরা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ এবং পরিবেশবান্ধব ইস্পাত প্রস্তুতকারক হতে চাই।” তিনি আরো জানান, কোম্পানি তাদের ‘সবুজ’ স্টিল উৎপাদনের দিকেই এখন থেকে মূলত মনোনিবেশ করবে এবং তারই অংশ হিসেবে এই পুনর্গঠন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যার ফলে প্রশাসনিক ও সাপোর্ট বিভাগে এই বিপুল সংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করা হবে। কোম্পানির ভাষ্য অনুযায়ী, এটি শুধু কর্মী ছাঁটাই নয়, বরং স্থায়ী খরচ কমানো, উৎপাদন পদ্ধতি সহজ করা এবং পণ্যের গুণগত মান ও লাইন আপে উন্নয়ন আনার জন্য একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।
তবে প্রশ্ন হলো, এই কৌশলগত পরিবর্তনের কষাঘাত যাঁরা সরাসরি অনুভব করছেন, সেই কর্মীরা আজ কোথায় দাঁড়িয়ে? এক টাটা কর্মী, যিনি ১৮ বছর ধরে কোম্পানিতে কাজ করছেন, চোখে জল নিয়ে বলেন, “টাটা মানে ছিল গ্যারান্টি। জীবনের নিরাপত্তা। আজ এই খবর শুনে মনে হচ্ছে, মাটিটা যেন পায়ের নিচ থেকে সরে গেল।” এমন নয় যে এই ঘোষণার আগেই কোনো আভাস ছিল, বরং এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ করেই কর্মীদের মাথার ওপর আছড়ে পড়েছে, যার ফলে মানসিক চাপ, আর্থিক দুশ্চিন্তা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা সব মিলিয়ে একটা তীব্র হতাশার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। তারা বলছে, এই ছাঁটাইয়ের মধ্যে মানবিকতা নেই, কোম্পানি তাদের সামাজিক দায়িত্ব ভুলে শুধুই ব্যবসায়িক হিসেবেই এগোচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন নেতা হেনক দ্য ফ্রিস বলেন, “আমরা চাই পুনর্বাসন, আমরা চাই কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও নতুন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হোক। এভাবে ১৬০০ পরিবারকে পথে বসানো চলবে না।” এমন সময়ে স্থানীয় সরকারও আলোচনায় নেমেছে, এবং তারা কোম্পানির সাথে একাধিক পর্যায়ে মিটিং করছে যাতে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের নতুন চাকরির সুযোগ, স্কিল ডেভেলপমেন্ট এবং আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা যায়। ইউরোপের অনেক দেশেই বড় বড় কোম্পানি সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে পুনর্বাসন কর্মসূচি চালায়, কিন্তু এতবড় এক বহুজাতিক সংস্থা যখন ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেয়, তখন সেটার মানসিক ও সামাজিক প্রভাব অনেক বেশি হয়।
এছাড়াও, অনেক কর্মী যাঁরা বছর দশেক বা তার বেশি সময় ধরে কাজ করছেন, তাঁরা শুধু চাকরি হারাচ্ছেন না, তাঁদের পরিচয়, তাঁদের আত্মসম্মান, তাঁদের জীবনযাপন সব কিছু একসাথে দুলে উঠছে। এক কর্মী বলেন, “এই বয়সে আমরা নতুন চাকরি কোথায় পাব? বাড়িতে দুটো বাচ্চা পড়াশোনা করে, EMI চলছে, এখন কিভাবে চালাবো?” এই পরিস্থিতি শুধু ওই কর্মীদের জীবন নয়, আশেপাশের দোকানদার, বাসচালক, স্কুল শিক্ষক, চিকিৎসক—সবার ওপর প্রভাব ফেলবে। কারণ, এইসব কর্মীরাই ছিলেন স্থানীয় অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর অংশ, তাঁদের দৈনন্দিন খরচে দোকান চলত, তাঁদের বাচ্চারা স্কুলে পড়ত, তাঁদের করেই শহরের একটা বড় অংশ সচল থাকত।টাটা স্টিল বরাবরই একটি মর্যাদাপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য নাম হিসেবে পরিচিত। ভারতে টাটার ভাবমূর্তি ‘পিপল ফার্স্ট’ ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে উঠেছে বহু বছর ধরে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত সেই ভাবমূর্তিকে কিছুটা হলেও ধাক্কা দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। যদিও টাটা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই পুনর্গঠনের পেছনে প্রধান কারণ হলো কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন চালানো। বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোর পরিবেশ নীতির কারণে কোম্পানিকে দ্রুত কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে কাজ করতে হচ্ছে। এর জন্য প্রয়োজন উচ্চ প্রযুক্তি, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি, এবং দক্ষ কর্মী, যার জন্য পুরোনো প্রশাসনিক কাঠামো ও অতিরিক্ত খরচ কমানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এই সবুজ শিল্পায়ন বা পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে গিয়ে যদি কর্মজীবন ধ্বংস হয়, তবে আদৌ কি সেটিকে প্রকৃত ‘সবুজ উন্নয়ন’ বলা যায়? পরিবেশ রক্ষার নামে যদি হাজার হাজার কর্মী পথে বসেন, তাহলে এই উন্নয়ন কার জন্য? শুধুই কি ব্যবসার জন্য? এমন প্রশ্ন তুলছে অনেকেই। তবে আশার আলো এই যে, টাটা কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় প্রশাসন একসাথে বসে বিকল্প সমাধান খুঁজছে। নতুন ট্রেনিং প্রোগ্রাম, অন্যান্য সহযোগী কোম্পানিতে কর্মসংস্থান তৈরি, অথবা সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে এই কর্মীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে।এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও উঠে এল এক চিরন্তন সত্য—বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলোর সিদ্ধান্ত কখনো কখনো মানুষের জীবনকে এক নিমেষেই বদলে দিতে পারে। একদিকে বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে পরিবেশ রক্ষা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির চাপে পড়ে, কোম্পানিগুলো কর্মীদের সংখ্যা কমাতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেই একই সময়ে, যদি মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা, তাদের ভবিষ্যতের আশ্বাস না থাকে, তবে সেই ‘উন্নয়ন’ মানুষের চোখে একটি আতঙ্কে পরিণত হয়।
তাই টাটা স্টিলের এই সিদ্ধান্ত শুধু ১৬০০ জনের চাকরি চলে যাওয়া নয়, এটি এক সামাজিক, মানবিক এবং অর্থনৈতিক বার্তা বহন করে। এই সিদ্ধান্ত আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দেয় যে, প্রযুক্তি আর পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের পাশাপাশি, মানুষের জীবনের মূল্য বোঝা, তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং পুনরুদ্ধারের পথ তৈরি করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।