Beware of urine infection!বর্তমান সময়ে ইউরিন ইনফেকশন (UTI বা Urinary Tract Infection) খুব পরিচিত একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী এবং পুরুষ উভয়েই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে বিশেষত নারীরা এই সংক্রমণের শিকার বেশি হন। এটি মূলত ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রমণ, যা মূত্রতন্ত্রের ভেতরে প্রবেশ করে বিভিন্ন সমস্যার জন্ম দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজের স্বাস্থ্য এবং হাইজিনের ব্যাপারে একটু সচেতন থাকলেই ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। চলুন, সহজ ভাষায় এই রোগটির কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধের উপায় এবং চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
ইউরিন ইনফেকশনের কারণ
ইউরিন ইনফেকশন মূলত মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ। আমাদের শরীরের বর্জ্য এবং অতিরিক্ত জল প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত অঙ্গগুলি হলো কিডনি, ইউরেটার (দুইটি টিউব যা কিডনি থেকে মূত্র থলিতে প্রস্রাব নিয়ে যায়), ব্লাডার (মূত্র থলি), এবং ইউরেথ্রা (মূত্রনালি)। মূত্রনালি দিয়ে জীবাণু প্রবেশ করলে সেটি দ্রুত মূত্রতন্ত্রে ছড়িয়ে পড়ে এবং সংক্রমণ তৈরি করে।
মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে –
- পর্যাপ্ত জল না খাওয়া: জল কম খেলে মূত্র থলিতে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে যায় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।
- অপরিচ্ছন্নতা: নিয়মিত স্নান না করা এবং গোপনাঙ্গ পরিষ্কার না রাখলে জীবাণু সংক্রমণ ঘটতে পারে।
- টাইট অন্তর্বাস পরা: অনেকেই টাইট অন্তর্বাস পরেন, যা যৌনাঙ্গকে আর্দ্র রাখে এবং ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করে।
- মেনোপজ এবং হরমোনজনিত পরিবর্তন: নারীদের ক্ষেত্রে মেনোপজের সময় ইউটিআইয়ের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ইউটিআই হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
ইউরিন ইনফেকশনের সাধারণ লক্ষণ
ইউরিন ইনফেকশন হলে শরীরে কিছু লক্ষণ দেখা দেয়, যেগুলো সহজেই বুঝতে পারা যায় –
- প্রস্রাব করতে গিয়ে জ্বালা বা ব্যথা হওয়া।
- ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হওয়া কিন্তু অল্প পরিমাণ প্রস্রাব হওয়া।
- প্রস্রাবের দুর্গন্ধ।
- প্রস্রাবে রক্ত বা ঘোলাটে ভাব দেখা দেওয়া।
- কোমর বা তলপেটে ব্যথা।
- জ্বর এবং কাঁপুনি।
ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধের উপায়
সচেতনতা এবং কয়েকটি স্বাস্থ্যকর অভ্যাস মেনে চললে ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়। বিশেষজ্ঞরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন –
- পর্যাপ্ত জল পান করা: দিনে অন্তত ২.৫ থেকে ৩ লিটার জল পান করলে মূত্রতন্ত্র পরিষ্কার থাকে এবং ব্যাকটেরিয়া প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়।
- সঠিক অন্তর্বাস ব্যবহার: ঢিলেঢালা এবং পরিষ্কার সুতি অন্তর্বাস ব্যবহার করুন, যা শরীরে বাতাস চলাচল করতে সাহায্য করে।
- অপরিচ্ছন্নতা এড়িয়ে চলা: নিয়মিত স্নান এবং গোপনাঙ্গের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
- প্রস্রাব চেপে রাখা থেকে বিরত থাকা: প্রস্রাব চেপে রাখলে মূত্র থলিতে জীবাণু জমে এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।
- যৌন স্বাস্থ্য সচেতনতা: যৌনমিলনের পর প্রস্রাব করা এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক।
- সুগন্ধিযুক্ত প্রোডাক্ট এড়িয়ে চলা: অনেক সময় সুগন্ধিযুক্ত সাবান বা ওয়াইপস ব্যবহারের ফলে সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ে।
ইউরিন ইনফেকশনের চিকিৎসা
ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। অনেকেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক খান, যা বিপজ্জনক হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে। এছাড়া চিকিৎসার পাশাপাশি পর্যাপ্ত জলপান এবং বিশ্রাম নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।
কথা বললেন বিশেষজ্ঞরা
এই বিষয়ে কলকাতার এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. সৌরভ ঘোষ বলেন, “ইউরিন ইনফেকশনের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ হলো পর্যাপ্ত জলপান এবং গোপনাঙ্গের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। অনেকেই প্রস্রাব চেপে রাখেন, যা একেবারেই উচিত নয়। এটি জীবাণু বৃদ্ধির জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে।”
অন্যদিকে নারীদের জন্য বিশেষ সতর্কতা দিয়েছেন গাইনোকোলজিস্ট ডা. মাধবী সেন। তিনি বলেন, “মেনোপজের পর হরমোনের পরিবর্তনের কারণে অনেক নারীর ইউটিআইয়ের সমস্যা হয়। তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং জলপানের বিষয়ে যত্নবান হতে হবে।”
ইউরিন ইনফেকশন নিয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা
বাগবাজারের বাসিন্দা অনিমা দত্ত নিজের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করে বলেন, “আমি প্রায়ই ইউরিন ইনফেকশনে ভুগতাম। পরে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জলপান বাড়াই এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে মন দিই। এখন আর সেই সমস্যা নেই।”
ইউরিন ইনফেকশন এবং বর্তমান পরিস্থিতি
বর্তমান সময়ে ইউরিন ইনফেকশনের সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো মানুষের ব্যস্ত জীবনযাত্রা এবং অবহেলা। ঠিকমতো জল না খাওয়া, ফাস্টফুড খাওয়ার প্রবণতা, এবং অপরিষ্কার অভ্যাস এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। তবে সচেতনতা বাড়লে এবং সঠিক অভ্যাস গড়ে তুললে এই সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
উপসংহার
ইউরিন ইনফেকশন একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, যা সময়মতো সচেতন হলে প্রতিরোধ করা যায়। পর্যাপ্ত জলপান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাসই পারে এই রোগ থেকে মুক্তি দিতে। তাই শরীরের সংকেতগুলিকে গুরুত্ব দিন এবং সুস্থ থাকুন।