বৃহস্পতিবার বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দিরে শারদীয়া দুর্গোৎসবের শুভ সূচনা হলো ৪০০ বছরের পুরনো রীতি মেনে। প্রতিপদ থেকে শুরু হওয়া এই দুর্গোৎসবের প্রথম ধাপ ছিল ঘট প্রতিষ্ঠা। সেই সঙ্গে গোটা রাঢ় বাংলাতেও পুজোর আনুষ্ঠানিক সূচনা হলো। মন্দিরের ট্রাস্ট বোর্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, রাজ আমলের সময় থেকে এই রীতি আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে এবং এটি বর্ধমানের অন্যতম প্রধান ঐতিহ্যবাহী উৎসব।
বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দির রাঢ় বাংলার দেবী পূজার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এই মন্দিরে দুর্গাপূজার সূচনা ঘটে ঘট উত্তোলনের মাধ্যমে। বৃহস্পতিবার সকালে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে ঘট উত্তলনে যান মন্দির কমিটির সদস্যরা। এই শোভাযাত্রায় ছিল বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি, সুশোভিত ঘোড়ার গাড়ি, এবং উৎসুক জনতার ভিড়। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রূপোর ঘট নিয়ে কৃষ্ণসায়ের থেকে পবিত্র জল সংগ্রহ করেন। তারপর ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়িতে করে সেই ঘট মন্দিরে আনা হয়।
রাজ আমলের রীতিমতো ঘট প্রতিস্থাপন এবং চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে শুরু হয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত চণ্ডীপাঠের সঙ্গে শুরু করেন পূজা। ট্রাস্ট বোর্ডের সম্পাদক সঞ্জয় ঘোষ বলেন, “রাজ আমলের রীতি মেনেই প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত চলবে চণ্ডীপাঠ। নবমীর দিন অনুষ্ঠিত হবে কুমারী পূজা, যেখানে নয়জন কন্যাকে দেবীর রূপে পূজা করা হবে। এটি রাঢ় বাংলার ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”
সর্বমঙ্গলা মন্দিরের ঐতিহ্যবাহী এই পুজোয় পশুবলির রীতি একসময় প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার পরিবর্তে আঁখ, ছাঁচি কুমড়ো বলি দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এই প্রথাটি বর্ধমান তথা রাঢ় বাংলার ধর্মীয় সংস্কৃতির একটি বিশেষ পরিচয় বহন করে। মন্দিরের ট্রাস্ট বোর্ডের এক সদস্য জানান, “আমরা রাজ আমলের রীতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পূজার সমস্ত আয়োজন করি, এবং মা সর্বমঙ্গলার প্রতি ভক্তি নিবেদন করতে হাজার হাজার মানুষ এই মন্দিরে আসেন।”
এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বর্ধমান পৌরসভার চেয়ারম্যান পরেশ চন্দ্র সরকার, বিধায়ক খোকন দাস, মন্দিরের ট্রাস্ট বোর্ডের অন্যান্য সদস্য এবং বিশিষ্ট মানুষজন। পূজা আয়োজনে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ লক্ষ্য করা গেছে। এলাকার মানুষদের মতে, এই পুজো তাদের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে এবং এটি তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ।
স্থানীয় বাসিন্দা কৃষ্ণ ঘোষ বলেন, “সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পুজো আমাদের এলাকার প্রধান উৎসব। এই পুজো শুধু ধর্মীয় নয়, আমাদের সংস্কৃতিরও প্রতীক।” অন্যদিকে, পূজার অংশগ্রহণকারী এক নারী, সন্ধ্যা মিত্র বলেন, “এই পুজো আমাদের নারীশক্তির প্রতীক। নবমীতে কুমারী পূজা দেখতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন। এটি আমাদের মেয়েদের শক্তি ও সম্মানের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।”
প্রতি বছরই এই মন্দিরের পুজো দেখতে আশেপাশের এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন। এই পুজোকে কেন্দ্র করে বর্ধমান শহর এক নতুন প্রাণশক্তি লাভ করে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পুজোর সময় তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমেও বিশেষ চাঙ্গা ভাব দেখা যায়। দোকানদার রাজেশ দত্ত বলেন, “দুর্গাপূজার সময় আমরা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অনেক লাভবান হই। মন্দিরে আগত দর্শনার্থীরা কেনাকাটায় বিশেষ উৎসাহী থাকেন।”
এই পুজো শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বর্ধমান তথা রাঢ় বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। মন্দিরের ট্রাস্ট বোর্ডের সম্পাদক সঞ্জয় ঘোষ আরও বলেন, “এই পুজোর মাধ্যমে আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে সুরক্ষিত রাখতে চাই। নতুন প্রজন্ম যাতে এই প্রাচীন রীতির সঙ্গে পরিচিত হয়, সেটাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। মা সর্বমঙ্গলার পূজার মাধ্যমে আমরা রাঢ় বাংলার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চাই।”
বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দিরের এই শারদীয়া দুর্গোৎসব শহরের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে এক অনন্য সমন্বয়ের প্রতীক। পূজোর সময় শহরে যেমন ধর্মীয় উন্মাদনা দেখা যায়, তেমনই এটি একটি সামাজিক মিলনমেলার পরিবেশ তৈরি করে। মন্দিরের এই পুজোয় অংশ নিতে প্রতিবছর দূরদূরান্ত থেকে আসা ভক্তরা মন্দিরে ভিড় জমায়।
স্থানীয় প্রশাসনও এই সময়ে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ভিড় নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং পূজা সম্পূর্ণ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বর্ধমানের পূজা কমিটির একজন সদস্য বলেন, “আমরা সবসময় প্রশাসনের সহায়তা পাই এবং সেই অনুযায়ী সব ব্যবস্থা নিই যাতে পূজোর সময় কোনও ধরনের অসুবিধা না হয়।”
এই পুজোর প্রভাব শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি বর্ধমানের পর্যটন শিল্পের জন্যও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বহু পর্যটক এই সময়ে শহরে আসেন এবং সর্বমঙ্গলা মন্দিরে দুর্গা পূজার চমৎকার আয়োজন দেখতে আসেন। এটি শহরের অর্থনীতিতেও একটি বড়সড় প্রভাব ফেলে। স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ী অরুণ সান্যাল বলেন, “প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় পর্যটকদের ভিড় বেড়ে যায় এবং আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও বিশেষ উন্নতি ঘটে।”
এইভাবে, বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দিরের শারদীয়া দুর্গোৎসব শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি শহরের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এই পুজোকে ঘিরে বর্ধমানবাসীর মধ্যে যে উন্মাদনা এবং উচ্ছ্বাস রয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। সারা বছর জুড়ে যে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়, তার মধ্যে সর্বমঙ্গলা মন্দিরের শারদীয়া দুর্গোৎসব নিঃসন্দেহে অন্যতম প্রধান। এই পুজোর মাধ্যমে রাঢ় বাংলার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে আগামী প্রজন্মের কাছেও এটি এক বিশেষ উৎসাহের কারণ হয়ে থাকবে।