Balochistan:একটা সময় ছিল যখন বালোচিস্তানের বিদ্রোহের খবর শুধু সীমান্ত সংক্রান্ত কূটনৈতিক আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, কিন্তু এখন সেসব বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এক ভয়ানক বাস্তবতায়, যার সর্বশেষ উদাহরণ বালোচ লিবারেশন আর্মি (BLA)-র ‘ডেথ স্কোয়াড’-এর হাতে মাঙ্গোচর শহর দখলের ঘটনা। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বালোচিস্তানের কলাট জেলার এই ছোট্ট শহর যেন এক মুহূর্তেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মুখোশধারী সশস্ত্র ক্যাডাররা কোয়েটা-করাচি হাইওয়ে বন্ধ করে দেয়, গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি চালায়, এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বাজারে ঢুকে সরকারি দফতরে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাকিস্তানের প্রশাসন এখনও পর্যন্ত এই ঘটনা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না বললেও, অভ্যন্তরীণ সূত্রের খবর—শহর পুনর্দখল করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এত সহজে শহর উদ্ধার করা সম্ভব নয়, কারণ মাঙ্গোচরের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি চলে গিয়েছে BLA-র দখলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে একাধিক ভিডিও, যেখানে দেখা যাচ্ছে বালোচ লিবারেশন আর্মির যোদ্ধারা রাস্তা আটকে গাড়ি তল্লাশি করছে। একটি ভাইরাল ভিডিওতে অজয় কল নামক এক ব্যক্তি লিখেছেন, “এটি বালুচিস্তানের কলাট জেলার মাঙ্গোচর শহর। যেখানে কয়েক ঘন্টা আগে মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনার প্রধান ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ দখল করেছে।
এমনকি ব্যাংক, আদালত ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভবনও এখন তাঁদের দখলে।” বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের সামরিক দিক থেকে এটা একটা বড়সড় ধাক্কা, কারণ এভাবে একটি শহর পুরো দখলে নেওয়ার ঘটনা শুধুমাত্র বিদ্রোহ নয়, এটা একটা স্পষ্ট বার্তা যে বালোচিস্তানের ভূখণ্ডের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। কে এই বালোচ লিবারেশন আর্মি (BLA)? ১৯৭০-এর দশকে গঠিত এই সংগঠনটি বালোচিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করে। সংগঠনটি বিশ্বাস করে পাকিস্তান সরকার বালোচদের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ করছে অথচ তাঁদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। BLA নিজেকে বালোচ জনগণের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরলেও, পাকিস্তান সরকার ও আন্তর্জাতিকভাবে কিছু দেশ এদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ সংগঠন হিসেবেই চিহ্নিত করেছে। তবে এই ‘ডেথ স্কোয়াড’ মডেল যে তারা এখন প্রয়োগ করছে, তা অনেকটা আইএসআইএস বা তালিবানদের মতো গেরিলা কৌশলের আদলে গড়ে ওঠা—যেখানে তারা হঠাৎ হামলা চালিয়ে এলাকা দখল করে নেয় এবং সাধারণ মানুষ ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জানায়, মাঙ্গোচরে হামলার পরে বেশ কয়েকজন সেনাকর্মী নিখোঁজ রয়েছেন এবং স্থানীয় পুলিশ বাহিনীও কার্যত অসহায়। শুধু তাই নয়, বেশ কয়েকজন পাকসেনা এবং সরকারি আধিকারিককে বন্দি করে রেখেছে BLA, এমনটাই জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলি। এই ঘটনাকে ঘিরে রাজনৈতিক মহলেও উত্তেজনা ছড়িয়েছে। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এখনও পর্যন্ত মুখ না খুললেও, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এর জন্য সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করছে। ‘ডন’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পাকিস্তান প্রশাসনের উচিত বালোচিস্তানবাসীদের মৌলিক চাহিদা ও অধিকারকে সম্মান জানানো, নইলে এই ধরনের দখলদারি আরও বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক সালমান রাজা বলছেন, “এই হামলার সময় খুবই কৌশলে পাক সেনার দৃষ্টি সীমান্তের দিকে ঘোরানো হয়েছিল। এলওসি-তে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, বালোচিস্তানে বড় হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল BLA। তারা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছিল, এবং তা সফলভাবেই করেছে।” শুধু সামরিক দিক নয়, এই ঘটনার প্রভাব পড়ছে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রাতেও। মাঙ্গোচর শহরের বাসিন্দারা এখন কার্যত আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। বাজার, স্কুল, হাসপাতাল সবই বন্ধ। মানুষ গৃহবন্দি হয়ে রয়েছেন। খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ থমকে গেছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করে জানান, “রোজ রাতে মনে হচ্ছে কেউ দরজায় কড়া নাড়বে আর বলবে বাড়ি খালি করে দিন। এখানে এখন প্রশাসন বলতে কিছু নেই।” এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে—পাকিস্তান কি আদৌ এই বিদ্রোহ দমন করতে পারবে? বিগত কয়েক মাসে এই নিয়ে পঞ্চম বড়সড় হামলা চালাল BLA। এর আগে এক ট্রেন হাইজ্যাক, সেনাশিবিরে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ, আইডি ব্লাস্টে ১০ জন সেনার মৃত্যু, এবং গ্যাসপাইপলাইন ধ্বংস করে দিয়েছে এই সংগঠন। প্রতিটি হামলা যেন পাক সরকারের শিথিলতা আর বালোচদের দুঃখ-অভিযোগের মূর্ত প্রতীক। আর তার থেকেও বড় কথা—পাকিস্তান বারবার এই বিদ্রোহের জন্য ভারতকে দায়ী করলেও, কোনও আন্তর্জাতিক প্রমাণ দিতে পারেনি। ফলে প্রশ্ন উঠছে, ভারত নয়, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বৈষম্য আর সামরিক আধিপত্যই কি এই সমস্যার মূল কারণ? বিশেষজ্ঞদের মতে, “এটা শুধু নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, এটা মানবাধিকারের প্রশ্ন। বালোচদের প্রতি যে অবিচার চলছে, তার শেষ নেই। এটা যদি না বন্ধ হয়, তাহলে পাকিস্তানের আরও শহর দখলে যেতে পারে।” এই ঘটনার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও শুরু হয়েছে। আফগানিস্তান, ইরান এবং চীনের কূটনৈতিক মহল গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কারণ এই অঞ্চলটি ‘চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর’-এর অংশ। যদি নিরাপত্তা সঙ্কট বাড়ে, তবে চীনের বিনিয়োগ ও সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হবে। ফলে বিষয়টি শুধু পাকিস্তান বা বালোচিস্তান নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতির জটিলতা বোঝাতে গেলে এটা বলাই যায়, এই মুহূর্তে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ এখন আর ভারত নয়, বরং নিজের ঘরের ভেতরেই বেড়ে ওঠা আগুন।