Arjun Singh holds Israeli flag, sparks controversy : রামনবমী মানেই ধর্মীয় উৎসবের উন্মাদনা, ধর্মীয় মিছিল, ঢাকঢোল, আবির আর ভক্তির সুরে গমগম করা রাজপথ। কিন্তু এবারের রামনবমী একটু অন্যরকম ভাবে নজর কেড়ে নিল পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুর এলাকায়। ভাটপাড়া থেকে হনুমান মন্দির পর্যন্ত বিশাল শোভাযাত্রা বার করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আর সেই শোভাযাত্রাতেই উপস্থিত ছিলেন ব্যারাকপুরের প্রাক্তন সাংসদ ও বিজেপি নেতা অর্জুন সিং। তবে বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এলেন তিনি যখন দেখা গেল, তার হাতে ভারতীয় জাতীয় পতাকার পাশাপাশি ছিল ইজরায়েলের জাতীয় পতাকা! শুধু তাই নয়, অর্জুনের ছেলে ও ভাটপাড়ার বিধায়ক পবন সিং এর শোভাযাত্রাতেও দেখা গেছে ইজরায়েলের পতাকা। মুহূর্তে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে, শুরু হয়ে যায় চরম বিতর্ক। কেউ বলছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অপব্যবহার, কেউ বলছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে টেনে এনে স্থানীয় আবেগে ঘৃতাহুতি দেওয়া।
মিছিলের ছবিগুলি সামনে আসতেই নানান মহল থেকে প্রশ্ন উঠতে থাকে—একটা ধর্মীয় মিছিলে কেন হঠাৎ ইজরায়েলের পতাকা? যেখানেই দেখা গেছে ধর্মীয় আবেগকে কেন্দ্র করে একটি বিদেশি দেশের জাতীয় পতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন এক প্রাক্তন সাংসদ। এই ঘটনাকে ঘিরে স্থানীয় মানুষদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, “এই ধরণের পতাকা নিয়ে মিছিল করা মানেই একপ্রকার ইঙ্গিত দেওয়া, যেটা রাজ্য বা দেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশের পক্ষে হুমকিস্বরূপ হতে পারে।” আবার কারও মতে, “পালটা মত প্রকাশের স্বাধীনতাও যদি থাকে, তাহলে ইজরায়েলের প্রতি সমর্থন জানানো অপরাধ নয়।”এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অর্জুন সিং নিজে মুখ খুলে বলেন, “ইজরায়েল আমাদের বন্ধু দেশ। তারা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ছে, যেভাবে আমরাও নিজেদের দেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ি। তাই ইজরায়েলের সমর্থনে পতাকা নিয়ে হেঁটেছি। এতে অন্যায় কিছু দেখছি না। মহরমের সময় যদি কেউ প্যালেস্টাইনের পতাকা নিয়ে হাঁটতে পারে, তাহলে রামনবমীতে আমি কেন ইজরায়েলের পতাকা নিতে পারব না?” অর্জুনের এই বক্তব্য যেমন একটা নির্দিষ্ট অংশের সমর্থন কুড়িয়েছে, তেমনি বিরোধীরা এটাকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর এক সুপরিকল্পিত চেষ্টা বলে অভিযোগ তুলেছে।

তৃণমূল কংগ্রেসের এক নেতার বক্তব্য অনুযায়ী, “এইভাবে বিদেশি দেশের পতাকা নিয়ে মিছিল করা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করে। এটা একটা বিপজ্জনক প্রবণতা, যেখানে ধর্মীয় আবেগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে।” অন্যদিকে পুলিশ প্রশাসনের নীরবতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। যখন মিছিলে অস্ত্র, অন্য দেশের পতাকা দেখা যাচ্ছে, তখন পুলিশ বা প্রশাসন কেন কোনও ব্যবস্থা নিল না, সেই নিয়েও সাধারণ মানুষ এবং নাগরিক সমাজ প্রশ্ন তুলছে। যদিও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঘটনাটি নিয়ে উচ্চতর মহল থেকে রিপোর্ট তলব করা হয়েছে এবং বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে সেই ভিডিও যেখানে অর্জুন সিং পতাকা হাতে হাঁটছেন, পাশাপাশি দেখা গেছে ভিড়ের মধ্যে কিছু অংশত মানুষ “ইজরায়েল জিন্দাবাদ” ধ্বনি দিচ্ছেন। এই ভিডিও নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত নেটিজেনরা—একপক্ষ বলছে এটা হিন্দুদের স্বার্থে ইজরায়েলের প্রতি সংহতি জানানো, অন্যপক্ষ বলছে এটা দেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরির এক ধূর্ত প্রচেষ্টা।
এই ঘটনার পিছনে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও বড় ভূমিকা নিচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বর্তমানে গাজা ও ইজরায়েল সংঘাতে গোটা বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত—একদল প্যালেস্টাইনের পক্ষে, অন্যদল ইজরায়েলের। আর ঠিক সেই সময়েই এধরণের প্রতীকী পদক্ষেপ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক তৈরি করতে বাধ্য। পশ্চিমবঙ্গের মতো সংবেদনশীল ও বহু ধর্মের সহাবস্থানের রাজ্যে এধরনের কর্মকাণ্ড যে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।স্থানীয় মানুষদের মধ্যেও শুরু হয়েছে তর্ক-বিতর্ক। একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক বললেন, “রাজনীতি থাকুক রাজনীতির জায়গায়, ধর্ম থাকুক ধর্মের জায়গায়। এভাবে মিশিয়ে দিলে সমাজে বিভ্রান্তি বাড়ে, সম্প্রীতি নষ্ট হয়।” অন্যদিকে এক যুবক বলেন, “ইজরায়েলকে সমর্থন করার মধ্যে কোনও দোষ নেই, কারণ ওরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ছে। আমাদেরও তেমন বন্ধু দরকার।”
ভবিষ্যতের কথা ভাবলে এই ধরণের ঘটনা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে, যেখানে রাজনৈতিক দল বা নেতারা আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে স্থানীয় স্তরে প্রভাব ফেলতে চাইবে। এটি যেমন একপ্রকার বিদেশি রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রচারের পথ করে দিতে পারে, তেমনি দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, বিভাজন ও সামাজিক অসন্তোষ তৈরি করতে পারে। এই ঘটনার জেরে ভবিষ্যতে প্রশাসনিক নজরদারি আরও কঠোর হতে পারে ধর্মীয় মিছিলগুলোতে, এমনকি দেখা দিতে পারে রাজ্য বনাম কেন্দ্র দ্বন্দ্বও, যদি কেন্দ্র এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানায়।শেষ পর্যন্ত এটা স্পষ্ট, অর্জুন সিং এর হাতে ইজরায়েলের পতাকা শুধু একটি ছবি নয়, এটা রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক স্তরে অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেল। কীভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেবে প্রশাসন, রাজনীতি, সমাজ—তা সময় বলবে। তবে এখনই বলা যায়, এবারের রামনবমী শুধু ঢাকঢোলের শব্দে নয়, বিতর্কের গর্জনেও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে ব্যারাকপুরবাসীর কাছে।