Anger over death of worker at Raniganj factory:রানীগঞ্জের বুকে রবিবারের রাতটা যেন আজও ভুলতে পারছে না বালাজি কারখানা এলাকার মানুষজন। চারপাশে ঘন অন্ধকার, তার মধ্যেই ঘটে গেল এক বিভীষিকাময় ঘটনা—একজন তরুণ শ্রমিক, নাম বিকাশ কুমার, তাঁর অকাল মৃত্যুকে ঘিরে গোটা এলাকাজুড়ে নেমে এল ধোঁয়াশা, ক্ষোভ আর প্রশ্নের ঝড়। রাতের প্রায় ৮টার দিকে ঘটে দুর্ঘটনা, আর ঠিক এক ঘণ্টা পর স্থানীয় সূরজ নামে এক যুবক খবর পান, বালাজি কারখানার ভিতরে দুর্ঘটনায় একজন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। এতেই সন্দেহের শুরু। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “রাত ৯টায় আমরা জানতে পারি যে কিছু একটা হয়েছে, অথচ ৮টার মধ্যেই পুলিশ এসে মৃতদেহ তুলে নিয়ে চলে যায়। কোনও চিহ্ন, কোনও নিরাপত্তার ব্যবস্থা, এমনকি প্রাথমিক তদন্তের চিহ্নমাত্র নেই! যেন কিছুই ঘটেনি!” তাঁর কথাতেই উঠে আসে অভিযোগ—এই মৃত্যু কি নিছকই দুর্ঘটনা? নাকি এর পেছনে রয়েছে গাফিলতি, আর সম্ভবত আরও কিছু লুকোনো সত্যি?
বিকাশ কুমার ছিলেন মাত্র ২৮ বছরের যুবক, যিনি এই কারখানায় একজন দক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু শ্রমিক পরিচয়ের বাইরেও তিনি ছিলেন রানীগঞ্জ শিল্পাঞ্চলের গর্ব, একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটার। স্থানীয় ক্লাবের হয়ে বহুবার চ্যাম্পিয়ন ট্রফি এনে দিয়েছেন নিজের চেষ্টায়। তাই তাঁর মৃত্যু শুধু একটি শ্রমিকের জীবন শেষ হওয়া নয়, একটি সম্ভাবনার, একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু। এই কারণে এলাকাবাসীর শোক যেন দ্বিগুণ। যে বিকাশ ছেলেটা সপ্তাহের ছয়দিন কারখানায় কাজ করে, রবিবার মাঠে নেমে বল হাতে জয় ছিনিয়ে আনত, আজ সেই ছেলেটাই চুপচাপ কফিনে শুয়ে ফিরছে। এই মৃত্যু কি স্বাভাবিক?
এই প্রশ্নগুলো থেকেই শুরু হয় প্রতিবাদ। সোমবার সকাল থেকেই গোটা এলাকা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শ্রমিকরা কারখানার মূল গেটে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। দাবি ওঠে – কারখানা কর্তৃপক্ষ অবহেলা করেছে, শ্রমিকদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই, মেশিনগুলি পুরোনো এবং অরক্ষিত। কারখানার ভিতরে সিসিটিভি থাকলেও, পুলিশের কাছে ফুটেজ চাওয়া হলে তারা তা দেখাতে অস্বীকার করে বলে অভিযোগ ওঠে। পুলিশের এই ব্যবহারেই আরো সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে, কারণ সিসিটিভি ফুটেজই ছিল সত্য উন্মোচনের একমাত্র রাস্তা।
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে টাউন প্রেসিডেন্ট রূপেশ যাদব বলেন, “আমরা বারবার বলেছি এই কারখানায় নিরাপত্তা নেই, শ্রমিকদের নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনও দায়বদ্ধতা নেই। বিকাশের মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, এটা গাফিলতির ফল। আমরা এর বিচার চাই, নাহলে আন্দোলন আরও বড় আকার নেবে।” তাঁর এই মন্তব্যে দেখা যায়, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখন রাজনৈতিক চাপানউতোরও শুরু হয়েছে। অন্যদিকে, পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বিকাশ কুমারের দাদারাও একই কারখানায় কাজ করেন। তাঁরা জানান, “বিকাশের মাথায় চোটের চিহ্ন ছিল, আর শরীরে ছিল কিছু আঁচড়। অথচ পুলিশ রিপোর্টে শুধু বলছে – দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু। কীভাবে ঘটল এই দুর্ঘটনা, কে দায়ী, কিছুই বলা হচ্ছে না।”
পুলিশ যদিও সোমবার সকালে এসে তদন্ত শুরু করে এবং ঘটনাস্থল সিল করে দেয়, কিন্তু ততক্ষণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হয়ত নষ্ট হয়ে গেছে। এমনটাই আশঙ্কা স্থানীয়দের। ঘটনাটিকে ‘ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন অনেকেই। রানীগঞ্জের বহু পুরনো শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস আছে, আর এবারও হয়তো সেই আগুন আবার জ্বলে উঠছে।
এই ঘটনার ভবিষ্যৎ প্রভাবও গভীর। প্রথমত, শ্রমিকদের মধ্যে একটা ভয় বাসা বেঁধেছে। তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। অনেকেই বলছেন, “আমরা সকালে বেরোলে আর নিশ্চিত হতে পারি না যে সন্ধ্যায় বাঁচা অবস্থায় বাড়ি ফিরব কিনা।” দ্বিতীয়ত, এই ঘটনা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে। শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম সুরক্ষা না থাকলে শিল্পাঞ্চলে আরও দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়বে। এর ফলে নতুন শ্রমিক আসতে চাইবে না, শিল্পকারখানার উৎপাদনেও প্রভাব পড়তে পারে। পাশাপাশি, ক্রীড়া মহলেও শোকের ছায়া। বিকাশের কোচ শিবু ঘোষ বললেন, “ও তো ছিল আমাদের দলের ভবিষ্যৎ অধিনায়ক। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, এমন মেধাবী একটা ছেলে আর নেই!”
সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, রানীগঞ্জের এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি গোটা শ্রমিক সমাজের এক কঠিন বাস্তবতা। যেখানে তারা প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন, কিন্তু তাদের জীবনের দাম যেন এক মেশিনের চেয়েও কম। এই মৃত্যুর তদন্ত সঠিকভাবে না হলে, শুধু বিকাশ নয় – আরও বহু শ্রমিকের জীবন অনিশ্চয়তার দিকে এগোবে। এখন দেখার, প্রশাসন সত্যিই এই ঘটনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে কিনা, না কি আবারও লুকোচুরি আর ধামাচাপার খেলায় হারিয়ে যাবে একজন শ্রমিকের মর্যাদা, একজন খেলোয়াড়ের স্বপ্ন, আর একটি পরিবারের শান্তি।