Ambari tea garden in Dooars closed without notice, 1200 workers worried : ডুয়ার্সের বানারহাট ব্লকের প্রাণকেন্দ্র আমবাড়ি চা বাগান। দীর্ঘদিন ধরেই এখানকার প্রায় ১২০০ শ্রমিক তাঁদের ঘাম ঝরিয়ে চা পাতা তুলে এনে গড়ে তুলেছেন এই চা বাগানের পরিচিতি। অথচ, সেই বাগানই একরাতের মধ্যেই তালাবন্ধ হয়ে পড়ল! কোনো নোটিশ ছাড়াই বন্ধ হয়ে যাওয়া এই চা বাগান নিয়ে এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তীব্র চাঞ্চল্য, আর শ্রমিকদের মধ্যে শুরু হয়েছে চরম দুশ্চিন্তা ও ক্ষোভের আগুন। এই ঘটনার পেছনে যে প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও মালিক পক্ষের একতরফা সিদ্ধান্ত কাজ করেছে, তা বলাই বাহুল্য।ঘটনার শুরু গত ২৬ জুন। চা বাগান মালিকদের সংগঠন ডিবিআইটিএ (Dooars Branch of Indian Tea Association)-তে একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাগান কর্তৃপক্ষ, শ্রমিক ইউনিয়ন ও প্রশাসনের উপস্থিতিতে। শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি, ন্যায্য পাওনা ও কাজের পরিবেশ নিয়ে এই বৈঠকে আলোচনা হলেও, শেষ পর্যন্ত কোনো মীমাংসা হয়নি। সেই কারণে বাগান কর্তৃপক্ষ একতরফাভাবে দশ দিনের শালছুটি ঘোষণা করে এবং শ্রমিক ইউনিয়নগুলি তা মেনে নেয়, আশায় ছিল আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বেরোবে।কিন্তু এই ছুটি শেষ হওয়ার পর, অর্থাৎ মঙ্গলবার যখন স্প্রে ওয়ার্কাররা যথারীতি কাজে যোগ দিতে যান, তখন তাঁদের চোখে পড়ে ফ্যাক্টরির স্টোররুমে তালা ঝুলছে। এরপর তাঁরা ম্যানেজারের বাংলোর দিকে গেলে সেখানেও তালা দেখতে পান। ম্যানেজার বা কোনো উচ্চপদস্থ কর্মচারীর উপস্থিতি না থাকায়, বিষয়টি আঁচ করতে দেরি হয়নি—চুপিচুপি পুরো বাগানটাই বন্ধ করে দিয়ে মালিকপক্ষ সরে পড়েছে। কোনো প্রকার নোটিশ বা ঘোষণা ছাড়াই এমন আচরণে হতবাক শ্রমিক মহল।চা শ্রমিক কল্পনা মুন্ডা, যিনি গত ১৫ বছর ধরে এই বাগানে কাজ করছেন, চোখে জল নিয়ে বলেন, “একটাও কথা বলল না ওরা! আমাদের কোনও দোষ ছিল না, তবুও এমনভাবে একরাতেই সব শেষ হয়ে গেল! আমাদের খাবার কেনার টাকাটাও নেই এখন।”
শুধু তিনিই নন, শ্রমিক নেতা বিজয় এক্কা জানান, “যে বাগান চালিয়ে রাখছে এই শ্রমিকরাই, তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে এমনভাবে তালা ঝুলিয়ে চলে যাওয়া সম্পূর্ণ অমানবিক। সরকার ও প্রশাসন যদি দ্রুত হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে এই চা বাগান এক নতুন রাজনৈতিক অশান্তির ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে।”ডুয়ার্স অঞ্চলের বহু চা বাগানে এমন আচমকা বন্ধ হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। কখনও বকেয়া মজুরি, কখনও PF বা স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত জটিলতা—সব মিলিয়ে চা শিল্পের এই অন্ধকার দিক শ্রমিকদের ভবিষ্যৎকে বারবার অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ডুয়ার্সের অনেক চা বাগানই বাজারে প্রতিযোগিতা, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় চায়ের দাম কমে যাওয়ার জন্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে করতে হবে, না-হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে।একই কথা জানিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসনের এক আধিকারিকও। তিনি বলেন, “এই বাগানটি বন্ধ হওয়ার কথা আমাদের জানানো হয়নি। আমরা আজই তদন্ত শুরু করেছি। শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে।”বর্তমানে এই আমবাড়ি বাগান চত্বর যেন এক অবরুদ্ধ, নীরব প্রতিবাদের মঞ্চ। ভোর থেকে শত শত শ্রমিক ফ্যাক্টরির গেটের সামনে জড়ো হন, কেউ গান গেয়ে প্রতিবাদ করছেন, কেউ আবার শিশুদের নিয়ে গেটের সামনে বসে রয়েছেন। স্থানীয় স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করে শ্রমিকদের সন্তানরা, তাঁদের অভিভাবকরাও দুশ্চিন্তায়—স্কুলের ফিস, বই কেনা, পোশাক—সবই এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।এক শ্রমিক পরিবারের মেয়ে সুমিতা হাঁসদা জানায়, “আমার বাবা-মা দুজনেই বাগানে কাজ করতেন। এখন যদি দুজনেই কাজ না পান, তাহলে আমাদের পড়াশোনা তো বন্ধ হয়ে যাবে!”

রাজ্যের শ্রম দফতরের কাছেও এই ঘটনা নিয়ে অভিযোগ জমা পড়েছে। বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলি আন্দোলনের রাস্তায় নামার পরিকল্পনা করছে, অন্যদিকে তৃণমূল সমর্থিত ইউনিয়ন প্রশাসনের তৎপরতার দাবি জানাচ্ছে।চা বাগান বন্ধ হওয়া মানে শুধুই ১২০০ জনের কাজ হারানো নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁদের পরিবার, স্থানীয় দোকানদার, ছোট হকার, অটোচালক থেকে শুরু করে বাগান-নির্ভর গোটা অর্থনীতি। এমন একতরফা সিদ্ধান্ত যে কী পরিমাণ ক্ষতি ডেকে আনছে, তার কোনও পরিসংখ্যানেই তা ধরা যাবে না।অতএব প্রশ্ন উঠছেই—এভাবে বারবার চা শ্রমিকদের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা চলতে থাকবে? একটাও নোটিশ ছাড়া যদি কোনও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তাহলে শ্রম আইনগুলি কাদের জন্য?এই ঘটনার দ্রুত সমাধান না হলে, আমবাড়ি চা বাগান একটি বৃহত্তর শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠবে বলেই মনে করছেন এলাকার বাসিন্দারা। প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়ছে, এবং রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও দ্রুত হস্তক্ষেপ না হলে ভবিষ্যতে ডুয়ার্সের চা শিল্পে আরও ধস নামতে পারে।