Allegations of burning two families to death : মালদা জেলার একটি ছোট্ট, শান্তিপূর্ণ এলাকা, যেখানে সাধারণত সন্ধ্যে নামলেই বাজার গুটিয়ে যায়, মানুষ নিজ নিজ গৃহে ফিরে যায়, সেই এলাকা আজ উত্তাল, শোকে মুহ্যমান। কারণ, সেখানেই ঘটেছে এক বিভীষিকাময় ঘটনা—একসঙ্গে দুই পরিবারকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে, যা শুধু ওই অঞ্চল নয়, গোটা রাজ্যের মানুষকেই স্তম্ভিত করেছে। ঘটনাটি ঘটেছে ইংরেজবাজার ব্লকের অন্তর্গত একটি প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে ৩ এপ্রিল রাতে হঠাৎ আগুন লাগে দুটি বাড়িতে, আর আগুন নেভাতে গিয়ে দেখা যায়, ভিতরে আটকে পড়েছেন একাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু। দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ৭ জনকে, যাঁদের মধ্যে পাঁচজন ঘটনাস্থলেই মারা যান, দু’জন মালদা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি থাকা অবস্থায় মারা যান পরদিন সকালে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং পূর্বপরিকল্পিত হত্যা, যেখানে দুই পরিবারকে সম্পূর্ণ নির্মমভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
এই ঘটনা সামনে আসতেই গোটা এলাকা ঘিরে ফেলে পুলিশ। ঘটনাস্থলে ছুটে যান মালদার পুলিশ সুপার প্রদীপ কুমার যাদব, জেলা শাসক নীতিন সিংহানিয়া, ও সদর মহকুমা শাসক পঙ্কজ তামাং। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আগুন লাগার প্রকৃত কারণ জানতে ফরেনসিক টিম ডাকা হয়েছে। তবে প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, বাড়ির দরজা বাইরে থেকে বন্ধ ছিল, যার ফলে সন্দেহ প্রবল হয়েছে যে এটি পরিকল্পিত হামলা হতে পারে। এলাকাবাসী বলছেন, দুই পরিবারের মধ্যে পুরনো জমিজমা নিয়ে বিবাদ চলছিল, এবং সম্প্রতি তা নিয়ে তীব্র বাকবিতণ্ডাও হয়েছিল। মৃতদের মধ্যে ছিলেন বৃদ্ধা সরলা দাস (৭২), তাঁর পুত্রবধূ অনিতা (৩৫), নাতনি কিরণ (১০), প্রতিবেশী দেবব্রত সাহা (৪৫) ও তাঁর স্ত্রী চন্দনা সাহা (৪০)। বাকি দু’জনের পরিচয় জানা গেলেও তাদের পরিবারের অন্য সদস্যরা এখনও নিখোঁজ।
ঘটনার রাতে প্রতিবেশীরা আগুন দেখে ছুটে আসেন, কিন্তু আগুন এতটাই তীব্র ছিল যে ভেতরে ঢোকা অসম্ভব ছিল। এক প্রতিবেশী অজয় বর্মণ বলেন, “চিৎকার শুনে ছুটে আসি, কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা দেখে আমরা কিছুই করতে পারিনি। আমরা দেখলাম ঘরের ভেতর থেকে আর্তনাদ ভেসে আসছে, আর কিছুই করতে না পারার বেদনায় আমরা স্থবির হয়ে পড়েছিলাম।” অপর একজন বলেন, “এটা কোনোভাবেই দুর্ঘটনা নয়। এটা প্রতিশোধ, এটা খুন। আমরা চাই কঠিন শাস্তি হোক দোষীদের।”পুলিশ ইতিমধ্যেই সন্দেহভাজন হিসেবে চারজনকে আটক করেছে, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন মৃতদের আত্মীয়, যাঁর সঙ্গে জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলছিল। ইংরেজবাজার থানার ওসি জানান, “আমরা প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান নিচ্ছি, ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে, আগুন লাগানোর জন্য পেট্রোলজাত দ্রব্য ব্যবহার করা হয়েছে।” ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে এলে পুরো ঘটনা স্পষ্ট হবে।
এদিকে এই ঘটনার জেরে গোটা এলাকায় চরম আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। শিশুদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন অভিভাবকরা। এক স্থানীয় শিক্ষক বললেন, “শিক্ষা তো দূর, এখন মানুষ সন্ধে নামলেই দরজা বন্ধ করে বসে পড়ছে। এমন অমানবিক ঘটনা আগে কখনও দেখিনি।”
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে, মালদা শহরে যে “কার্নিভাল” উৎসব অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ২৫ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত, তার নিরাপত্তা নিয়েও প্রশাসন সতর্ক হয়েছে। কার্নিভাল ময়দান ঘুরে দেখেছেন জেলা শাসক নীতিন সিংহানিয়া, পুলিশ সুপার প্রদীপ কুমার যাদব, ইংরেজবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী সহ বিশিষ্ট কর্তারা। তাঁরা জানিয়েছেন, “আমরা এই উৎসবের প্রস্তুতি নিতেই এসেছিলাম, কিন্তু এই ঘটনায় আমরা আরও বেশি করে নিরাপত্তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যাতে কার্নিভালে অংশগ্রহণকারী লক্ষাধিক মানুষ নিশ্চিন্তে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারেন।”পাশাপাশি প্রশাসন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আটকাতে এলাকায় রাত্রিকালীন পুলিশ পেট্রোল বাড়িয়েছে। মালদা মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে মৃতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন জেলাশাসক, এবং তাঁদের সমস্ত রকম সাহায্য ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, “এটি একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। আমরা তদন্তের উপর কড়া নজর রাখছি। দোষীদের যেন কোনওভাবেই ছাড়া না হয়।”
এই ঘটনায় মুখ খুলেছেন রাজ্যের মানবাধিকার কমিশনও। তাঁরা পুলিশের কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট তলব করেছেন। একই সঙ্গে দাবি উঠেছে, এই ঘটনার বিচার যেন দ্রুত আদালতে শেষ হয় এবং দোষীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পান।এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে শোক ও ক্ষোভ। কেউ লিখছেন, “এ কেমন পাশবিকতা? দুইটি পরিবারকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হল! কোথায় গেল আমাদের মানবিকতা?” আবার কেউ বলছেন, “এ ঘটনা যদি শহরে হত, তাহলে এতক্ষণে গোটা রাজ্য জেগে উঠত। গ্রামে হলে কি জীবন মূল্যহীন?”
এই বিভীষিকাময় ঘটনাটি আবারও আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কিভাবে জমি বিবাদ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং দীর্ঘকালীন রেষারেষি এক দিনে পরিণত হতে পারে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে। সমাজে ক্রমবর্ধমান হিংসা এবং প্রতিহিংসার মানসিকতা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের? প্রশাসনের ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন।এই ঘটনাটি শুধু মালদার এক গ্রামের নয়, এটি গোটা সমাজের আয়না। আমরা যদি এখনই না জাগি, তাহলে এমন মৃত্যু আরও বাড়বে, আর আমরা শুধু খবর পড়েই শোক পালন করব। বড় প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এমন একটা সমাজ গড়ে তুলছি, যেখানে নিরাপদে বেঁচে থাকাও বিলাসিতা হয়ে উঠছে?