Alaska earthquake : আলাস্কার নির্জন সৌন্দর্যের মাঝে হঠাৎই নেমে এল প্রকৃতির রুদ্ররূপ। বুধবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট নাগাদ ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল দক্ষিণ আলাস্কা এবং আলাস্কা পেনিনসুলা এলাকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক সংস্থা ইউএসজিএস (USGS) জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৩, যা অত্যন্ত শক্তিশালী বলে ধরা হয়। কেন্দ্রস্থল ছিল সমুদ্রের তলদেশে, পোপোফ দ্বীপের স্যান্ড পয়েন্টের কাছাকাছি, মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে। ভূমিকম্পের পরপরই উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে জারি হয়েছিল সুনামি সতর্কতা, যদিও পরে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা এখনও কাটেনি। স্থানীয় বাসিন্দা এলিজা ম্যাকার্থি, যিনি স্যান্ড পয়েন্টের এক ছোট রেস্তোরাঁর মালিক, বলছিলেন, “আমার জীবনে এইরকম কম্পন কোনওদিন অনুভব করিনি। মনে হচ্ছিল, বাড়িটা যেন ভেঙে পড়বে। খুদে সন্তানকে জড়িয়ে ধরে আমরা দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসি। চারপাশে তখন শুধু গাড়ির অ্যালার্ম বাজছে, আর লোকজন ছুটোছুটি করছে।” প্রশাসনের তরফে দ্রুত উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়েছে। স্থানীয় স্কুল, গির্জা ও কমিউনিটি হলগুলিকে অস্থায়ী আশ্রয়স্থল হিসেবে খুলে দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের মুখপাত্র ব্রায়ান ডুগান জানিয়েছেন, “আমরা এখনো ক্ষয়ক্ষতির সম্পূর্ণ হিসেব পাইনি।
তবে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ভবনের ফাটল ও রাস্তার ক্ষতির খবর পেয়েছি। বিদ্যুৎ এবং মোবাইল পরিষেবা বিঘ্নিত হয়েছে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে।” ভূমিকম্পের সময় এবং তার কিছু পরে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একাধিক ছবি ও ভিডিও, যেখানে দেখা যাচ্ছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি দুলছে, বাড়ির আলমারি থেকে পড়ে যাচ্ছে বাসনকোসন, জানালার কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে। যদিও এই ভিডিওগুলোর সত্যতা খবর বাংলা স্বাধীনভাবে যাচাই করেনি, তবে এগুলো থেকেই আন্দাজ করা যায় আতঙ্কের প্রাবল্য। স্থানীয় এক পর্যটক স্টিফেন রিডার, যিনি আলাস্কার অ্যানকরেজ থেকে ছুটি কাটাতে এসেছিলেন, বলেন, “আমার জীবনে প্রথমবার এমন কিছু দেখলাম। প্রকৃতি কতটা শক্তিশালী হতে পারে, আজ তা বুঝলাম। আমরা তৎক্ষণাৎ উপকূল ছেড়ে পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে চলে গেছি, কারণ সুনামির আশঙ্কা শুনে আরও ভয় পেয়ে গেছিলাম।” প্রশাসনের তরফ থেকে লোকজনকে উপকূলবর্তী অঞ্চল ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয় ভূমিকম্পের কিছুক্ষণ পরেই। বাচ্চা-বুড়ো, পর্যটক-স্থানীয় নির্বিশেষে সকলে রাস্তা ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এই সময়ে দেখা যায় অনেকেই নিজেদের গাড়িতে করে দূরে সরে যাচ্ছেন, আবার অনেকেই হেঁটে পাহাড় বা উঁচু জায়গার দিকে উঠতে থাকেন। যদিও সুনামির সতর্কতা পরে প্রত্যাহার করা হয়েছে, তবু লোকজনের মনে এখনও আতঙ্ক রয়ে গিয়েছে।

ভূতাত্ত্বিকদের মতে, আলাস্কা এমনিতেই পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি, কারণ এটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারের অংশ। ১৯৬৪ সালের ‘গ্রেট আলাস্কান ভূমিকম্প’-এর স্মৃতি এখনও অনেকের মনে টাটকা, যা ছিল রিখটার স্কেলে ৯.২ মাত্রার — আজও আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন অনেক বেশি প্রস্তুত বলে মনে করা হচ্ছে। উদ্ধারকারী দল, চিকিৎসা পরিষেবা, রেড ক্রস এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি একযোগে কাজ করছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়তো সমুদ্রতীরবর্তী এলাকাগুলিতে হয়েছে, যেখানে ঘরবাড়ি ছোট ও কাঠের তৈরি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রের নিচে এত কাছাকাছি গভীরতায় ভূমিকম্প হওয়ায় এর প্রভাব আরও বেশি অনুভূত হয়েছে, এবং ভূমিকম্পের পর-পর আফটারশক হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আর্থস্কায়েন্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডঃ হেনরি ব্ল্যাক বলেন, “এই ধরনের ভূমিকম্প কখনও কখনও বড় সুনামির জন্ম দিতে পারে, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, এবারে বড় ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়নি। তবে ভবিষ্যতের জন্য আমাদের আরও প্রস্তুত থাকতে হবে।” এই ঘটনার পর অনেক মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছেন। কিছু পোস্টে দেখা যাচ্ছে, ভীত বাচ্চাদের শান্ত করছেন তাদের মা-বাবা, আবার কোথাও প্রার্থনার ছবি। কেউ কেউ আবার লিখেছেন, ‘ভগবানকে ধন্যবাদ, আমরা এখনও জীবিত’। এত বড় একটি ভূমিকম্পে প্রাণহানি এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে ঘোষণা করা না হলেও ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণ পরিসংখ্যান পেতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তবে প্রশাসন ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য ত্রাণ তহবিল ঘোষণা করেছে। আবহাওয়া ও ভূতাত্ত্বিক দফতরগুলি পরবর্তী কিছুদিন ওই অঞ্চলে সতর্কতা বজায় রাখতে বলেছে এবং বাসিন্দাদেরও ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী নির্মাণ ব্যবস্থা, ভূমিকম্প প্রতিরোধী অবকাঠামো ও সুনামি সতর্কতা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার বার্তাও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গোটা ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির রুদ্ররূপ কতটা অপ্রতিরোধ্য হতে পারে, আর মানুষ হিসেবে আমাদের সবসময়ই প্রস্তুত থাকতে হবে — শুধু প্রযুক্তি দিয়ে নয়, সচেতনতা ও সহমর্মিতা দিয়েও।