Air India flight diverted after missile attack in Israel : রবিবার রাতটা অন্যরকম ছিল—একদিকে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পারদ চড়ছিল, অন্যদিকে মাঝ আকাশে একঝাঁক নিরীহ যাত্রী নিয়ে উড়ে চলছিল এয়ার ইন্ডিয়ার একটি যাত্রীবাহী বিমান। দিল্লি থেকে ইজরায়েলের তেল আবিবগামী এআই-১৩৯ বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার যখন জর্ডনের আকাশসীমা অতিক্রম করছে, ঠিক তখনই এক ভয়াবহ খবর ভেসে আসে ককপিটে—ইজরায়েলের বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পার্কিং এলাকায় মিসাইল হামলা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এবং নিরাপত্তার স্বার্থে বিমানটি ঘুরিয়ে দেওয়া হয় আবু ধাবির দিকে। আতঙ্কিত যাত্রীরা প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারেননি, তবে যখন ক্রুরা জানিয়ে দেন বিমানের ল্যান্ডিং স্থগিত হয়েছে এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে অন্য গন্তব্যে তা ঘোরানো হচ্ছে, তখন ছড়িয়ে পড়ে উৎকণ্ঠা। ফ্লাইট ট্র্যাকিং সংস্থা ‘Flightradar24’-এর তথ্য অনুযায়ী, বিমানটি তখন বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে অবতরণের মাত্র এক ঘণ্টা আগেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে জানা যায়, হাউথি বিদ্রোহীরা এই হামলার দায় স্বীকার করেছে এবং তারা দাবি করেছে এটি ছিল ইজরায়েলের গাজা অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ। তারা নাকি একটি হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুঁড়েছিল, যা সরাসরি গিয়ে পড়ে টার্মিনাল ৩-এর পার্কিং এলাকায়।
বিস্ফোরণে তৈরি হয় এক বিশাল গর্ত, কমপক্ষে ছয়জন আহত হন, যদিও মূল রানওয়ে বা টার্মিনাল বিল্ডিং বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়। ভারতীয় বিমানে থাকা ২০০-র বেশি যাত্রীর মধ্যে বেশ কয়েকজনের পরিবার জানিয়েছে, তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল, কারণ বেশ কিছুক্ষণ তারা ইন্টারনেট বা যোগাযোগের বাইরে ছিল। বিমানে থাকা এক যাত্রী, মুম্বইয়ের ব্যবসায়ী অরুণ শেঠী বলেন, “আমরা তো জানতামই না কী হচ্ছে! হঠাৎ ঘোষণা এল, আমরা তেল আবিব যাচ্ছি না, অন্য কোথাও নামব। পরে ফোন চালু হলে দেখলাম খবর সব মিডিয়াতে। সত্যি বলতে, মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে এলাম।” যদিও এয়ার ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে এই ঘটনার পরপরই কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসেনি, তবে নাগরিক বিমান মন্ত্রকের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, “যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের প্রথম লক্ষ্য। আমরা ইজরায়েল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি এবং প্রয়োজনে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” জানা যাচ্ছে, ওই বিমানের ফিরতি ফ্লাইটটিও বাতিল করা হয়েছে এবং যাত্রীদের নিরাপত্তাজনিত কারণে পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এয়ার ইন্ডিয়া সাময়িকভাবে ইজরায়েল রুটে উড়ান স্থগিত রাখতে পারে।
এই হামলা শুধু বিমান পরিবহণ নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে চিন্তা তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাউথি বিদ্রোহীদের এই ধরনের দূর পাল্লার মিসাইল হামলা ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অবসরপ্রাপ্ত) অনিরুদ্ধ রায় বলেন, “হাউথিদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা দিন দিন বেড়েছে, এবং তারা এখন ইরানের সহায়তায় অত্যাধুনিক অস্ত্র পাচ্ছে। এই ঘটনা তার প্রমাণ। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর লক্ষ্য করে হামলা মানেই, এটি কেবল সামরিক বার্তা নয়, বরং আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার কৌশল।”
অন্যদিকে ইজরায়েলের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, “আমরা বিমানবন্দরের কার্যক্রম ফের সচল করেছি, তবে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা মোতায়েন করা হয়েছে। বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।” এদিকে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের জঙ্গি হামলার পর থেকেই গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। হাজার হাজার প্যালেস্টিনীয় প্রাণ হারিয়েছেন, বহু এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। এর জবাবে ইয়েমেনের হাউথি গোষ্ঠী, যারা আগে শুধু আঞ্চলিক যুদ্ধেই সক্রিয় ছিল, এবার সরাসরি ইজরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক হামলার পথ বেছে নিয়েছে। ভারতীয় কূটনৈতিক মহলেও এই ঘটনাকে গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, “ইজরায়েল ও ভারত দীর্ঘদিন ধরেই স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার, এই ধরনের হামলায় ভারতের নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা আন্তর্জাতিক স্তরে প্রভাব ফেলতে পারে।” পাশাপাশি ভারতীয় দূতাবাস থেকে ইজরায়েলে থাকা নাগরিকদের অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনার পরপরই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে নানান ভিডিও ও গ্রাফিক ছবি—যেখানে দেখা যায় বিমানবন্দরের পার্কিং লটে এক বিশাল গর্ত, আর আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ধাতব ধ্বংসাবশেষ। ঘটনাটিকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তা শুধু এই অঞ্চলের নয়, বরং গোটা বৈশ্বিক বিমান চলাচলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। ভারতের নাগরিক সমাজ এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, “এতবড় নিরাপত্তা ফাঁক কীভাবে সম্ভব? যদি বিমানটি আর এক ঘণ্টা এগিয়ে যেত, তাহলে কি আর কেউ বাঁচত?” এই প্রশ্ন এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে সব মহলে। বিশেষ করে ভারতীয় পরিবারগুলোর মধ্যে যাদের আত্মীয়-স্বজন ওই বিমানে ছিলেন, তাদের মনে এখনও রয়ে গেছে আতঙ্কের ছাপ। আন্তর্জাতিক মহল এখন নজর রেখেছে হাউথি গোষ্ঠী ও ইজরায়েল সরকারের পাল্টা পদক্ষেপের দিকে। অনেকেই বলছেন, এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইজরায়েল হয়তো ইয়েমেনের হাউথি দখলকৃত এলাকায় পাল্টা হামলা চালাতে পারে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য আরও অশান্তির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে এয়ার ইন্ডিয়ার যাত্রী সুরক্ষা ও আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সামগ্রিকভাবে এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, যুদ্ধ শুধু সীমান্তে নয়, তার অভিঘাত পৌঁছে যাচ্ছে আকাশে উড়ে চলা নিরীহ মানুষদের জীবনেও। একদিকে কূটনীতি, অন্যদিকে বাস্তব যুদ্ধের অভিঘাতে যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে পৃথিবীর স্থিতিশীলতা। ভারতীয় যাত্রীদের জন্য এটি কেবল একটি এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ছিল না, এটি ছিল বেঁচে ফেরার এক অমূল্য অভিজ্ঞতা।