AI Video: Tiger scare at school, students skipping school : একটি শান্ত গ্রামের প্রান্তে সকাল সকাল ঘুম ভাঙতেই ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক—“বাঘ ঢুকেছে স্কুলে!” আতঙ্কে বন্ধ হয়ে যায় স্কুল, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কেঁদে ওঠে, অভিভাবকরা ছুটে আসেন স্কুল চত্বর ঘিরে। কিন্তু, একটু পরেই জানা গেল, যে বাঘটিকে ঘিরে এত ভীতি ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, সেটি আদতে বাস্তব নয়, একটি এআই তৈরি ভিডিও! হ্যাঁ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এভাবেই একটি ভুয়ো বাঘ গ্রাস করে নিল গোটা এলাকার শিক্ষার পরিবেশ। ঘটনাটি ঘটেছে উত্তর চব্বিশ পরগনার সীমান্ত লাগোয়া একটি গ্রামীণ অঞ্চলে। ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রথম ছড়ায় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একটি স্কুলের আঙিনায় একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভিডিওটি এতটাই বাস্তবসম্মত যে প্রথম দর্শনে তা দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেটি সম্পূর্ণরূপে কৃত্রিম। এই ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়তেই স্কুলের ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, এমনকি শিক্ষক-শিক্ষিকারা ভয় পেয়ে যান। পরপর দুদিন স্কুল কার্যত অচল হয়ে পড়ে। স্থানীয় এক অভিভাবক, স্বপন দাস বলেন, “ছেলেমেয়েরা তো ভয়ে স্কুলেই যেতে চায় না। কেউ বলে বাঘ দেখেছে, কেউ বলে বাঘ ডিঙি পেরিয়ে এসেছে। এখন বুঝুন, পড়াশোনা হলো কোনখানে!”
গোটা ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন যখন তদন্ত শুরু করে, তখন ধরা পড়ে, এটি আসলে একটি ভুয়ো এআই জেনারেটেড ভিডিও। এই ধরনের ভিডিও তৈরি করা এখন নানা অ্যাপের মাধ্যমে খুব সহজ হয়ে গেছে, আর কিছু দুষ্টু মজা করতে গিয়েই হয়তো কেউ এটি বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু তার ফল যে এত ভয়াবহ হতে পারে, তা কেউ বুঝতে পারেনি। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানান, ভিডিওটি ছড়ানোর পর থেকেই ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি ৫০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক অসীম বিশ্বাস জানান, “প্রথমে আমরাও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তবে পরে পুলিশ ও বনদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি ভিডিওটি জাল। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের মানসিক প্রভাব পড়েছে ব্যাপক। এখন তারা ক্লাসে মন বসাতে পারছে না।”
ঘটনার সূত্র ধরে স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। পুলিশের এক কর্তা বলেন, “আমরা বিষয়টি খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখছি। ভিডিওটি কার থেকে ছড়াল, কে তৈরি করল, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এটি এক ধরনের সাইবার ক্রাইম হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।” প্রযুক্তির অপব্যবহারে কেমন করে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে, এই ঘটনাই তার এক বাস্তব উদাহরণ। যাদের কাজ ছিল শুধু একটি মজার ভিডিও বানানো, তাদের বোঝা উচিত ছিল, একটি এআই ভিডিও এমন একটি অঞ্চলের শিক্ষাগত কাঠামোকে কিভাবে নাড়িয়ে দিতে পারে।
এদিকে মনোবিদরাও বলছেন, ছোটদের মনে ভয় ঢুকলে তা সহজে যায় না। শিশু মন বিশেষজ্ঞ ডা. কাকলি বসু বলেন, “শিশুদের মনে যদি বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত ভয় ঢুকে পড়ে, তাহলে তারা প্রকৃতির থেকে দূরে সরে যেতে পারে, স্কুলে যেতেও ভীত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব ভয়ঙ্কর হতে পারে।” তাই শুধু তদন্ত ও শাস্তি নয়, এখন সময় এসেছে প্রযুক্তি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা, বিশেষ করে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ও অভিভাবকদের মধ্যে।
এই ঘটনার পরে শিক্ষা দফতরের তরফে একটি নির্দেশিকাও পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন স্কুলে, যেখানে বলা হয়েছে, “এআই ভিডিও বা ভুয়ো তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ালে তা নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করুন। প্রয়োজনে ছাত্রদের নিয়ে সচেতনতা সভা আয়োজন করুন যাতে তারা সত্য-ভুয়ো তথ্যের পার্থক্য বুঝতে শেখে।”
গ্রামেরই বাসিন্দা, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সঞ্চিতা মণ্ডল বলে, “ভবিষ্যতে আবার যদি বাঘ আসে, তাহলে কি স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে? আমরা তো ভালো করে পড়াশোনা করতে চাই। এখন ভয় পাচ্ছি।” এদিকে কিছু শিক্ষকের বক্তব্য, “ছাত্রদের উপস্থিতি ফের স্বাভাবিক করতে হলে শুধু নিরাপত্তা নয়, মানসিক সহযোগিতাও প্রয়োজন।”
এআই প্রযুক্তির উন্নতি যেমন আশীর্বাদ, তেমনই অপব্যবহারে হয়ে উঠতে পারে অভিশাপ। আজকে হয়তো বাঘের ভয়, আগামী দিনে অন্য কোনো ভয়াবহ পরিস্থিতি। তাই প্রশাসনের উচিত প্রযুক্তির অপব্যবহার রুখতে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া এবং সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করা। কারণ, শিশুদের পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তারা তো দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের শিক্ষা ও মনোবল রক্ষা করাই এখন সবার দায়িত্ব।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যেখানে একটি মিথ্যে ভিডিও মুহূর্তে ছড়িয়ে যেতে পারে, সেখানে স্কুল, অভিভাবক এবং প্রশাসনের মিলিত দায়িত্বে প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলাই একমাত্র সমাধান। নইলে এই ঘটনার মতো ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে — এবং তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শুধুই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।