After 40 years, Shiv Thakur’s land restored in East Burdwan: পূর্ব বর্ধমান জেলার বর্ধমান উত্তর বিধানসভার অন্তর্গত এক ছোট্ট জনপদ বেগুট – যেখানে ধর্ম আর সংস্কৃতির এক গভীর যোগসূত্র আছে। এই গ্রামের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছেন শিব ঠাকুর, আর তাঁরই নামে থাকা দেবত্তর সম্পত্তি ঘিরে সম্প্রতি ঘটে গেল এক অভূতপূর্ব ঘটনা – দীর্ঘ ৪০ বছর পর গ্রামবাসীরা একত্রিত হয়ে নিজের উদ্যোগে শিব ঠাকুর জিউর নামে থাকা প্রায় ৭.৩৫ একর জমি ও পুকুর পুনরুদ্ধার করলেন, যা এতদিন অসাধু কিছু মানুষের দখলে ছিল। গল্পটা ঠিক এমনই, যেন সিনেমার মতো — কিন্তু ঘটনাটা পুরোপুরি বাস্তব, আর এই বাস্তবতার কেন্দ্রে রয়েছে এক অদম্য ইচ্ছাশক্তি, ঐক্য এবং বিশ্বাস।মূল ঘটনা শুরু হয় বহুদিন আগেই, যখন এই বেগুট মৌজার ৫৫৪ নম্বর খতিয়ানভুক্ত জমির দাগ নম্বর ১৭১, ৯৪৬, ৯৪৭, ৯৪৮, ৯৬৬, ১৯১১, ১৯৬৬, ২০১২, ২১৫০ ও ২১৬৯ – মোট ৭.৩৫ একর জমি ও পুকুর সরকারিভাবে দেবত্তর সম্পত্তি হিসেবে ‘শিব ঠাকুর জিউ’ নামে বরাদ্দ করা হয়। ১৯৫২ সালের জমি হস্তান্তর আইন অনুসারে এই জমি সরকারি নথিতে দেবোত্তর হিসাবে রেকর্ডে ছিল। পুরনো দিনের নিয়ম অনুযায়ী, সেবাইতরা সেই জমি দেখাশোনা করতেন এবং সেখান থেকে গাজন, শিব পূজা, মন্দির সংস্কার, ধুনো পোড়ানো সহ বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পরিচালিত হত।
কিন্তু কালের গর্ভে অনেক কিছুই মুছে যেতে থাকে। পূর্ববর্তী সেবাইতরা কর্মসূত্রে বাইরে চলে যান, নতুন প্রজন্ম এসব বিষয়ে অজ্ঞ ও উদাসীন থেকে যায়। সেই সুযোগেই কিছু চতুর ব্যক্তি ধীরে ধীরে দেবত্তর জমির দখল নিয়ে ফেলেন। কেউ মাছ চাষ শুরু করেন পুকুরে, কেউ বাঁধ দেন জমির ওপর। এমনকি কেউ কেউ দাবিও করে বসেন, তারা ওই জমি ‘দস্তুরমতো’ টাকা দিয়ে কিনেছেন। কিন্তু শাস্ত্র ও আইন – উভয়ই বলে, দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রয়যোগ্য নয়। আর এখানেই শুরু হয় গ্রামবাসীদের জাগরণ।বেগুট গ্রামের মানুষেরা যখন জানতে পারেন তাদের বহু বছরের পূজার জমি দখল হয়ে গিয়েছে, তখন তাঁরা আর চুপ করে বসে থাকেননি। এলাকায় বছর বছর গাজন হয়, সবাই মিলে চাঁদা তুলে শিব ঠাকুরের পূজা হয়, অথচ সেই জমির মালিকানাই অন্য কারও হাতে! ব্যাপারটা মেনে নিতে না পেরে গ্রামের মানুষজন, বিশেষ করে জয়দেব হাটি, উৎপল সামন্ত, চন্দন দত্ত, জয়দেব মুখার্জী প্রমুখ সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসেন। তাঁরা দল গঠন করে স্থানীয় বিডিও অফিস ও B.L.R.O অফিসে তথ্য খোঁজাখুঁজি শুরু করেন, R.S., C.S., এবং L.R. পর্চা সংগ্রহ করেন, জমির প্রকৃত রেকর্ড ঘেঁটে বুঝে যান— এই জমি এখনও পর্যন্ত সরকারি কাগজে ‘শিব ঠাকুর জিউ’ নামেই আছে।
গ্রামবাসীরা আইনজীবীর পরামর্শ নিয়ে মিটিং করেন, কাগজপত্র তৈরি করেন এবং সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে, আইনি কাঠামোর মধ্যেই জমি পুনরুদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেন। এরপরই শুরু হয় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। দখলদারদের সামনে স্পষ্ট করে জানানো হয় যে, তাঁরা অবৈধভাবে দেবোত্তর জমি দখল করেছেন, এবং তা আইনত ফেরত দিতে বাধ্য। কিছু ক্ষেত্রে কথোপকথনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়, আবার কোথাও কোথাও বাধা এসেছে, কিন্তু অবশেষে গ্রামবাসীদের ধৈর্য, ঐক্য এবং বিশ্বাসের জয় হয়েছে।

বর্তমানে এই জমির একাংশে নতুন করে মন্দির সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। পরিষ্কার করা হয়েছে পুকুর, সেখানে এখন আবার পুকুরে ফুল ভাসানো, সন্ধ্যায় ধুনো পোড়ানো, ভক্তদের উপস্থিতিতে নাম সংকীর্তন শুরু হয়েছে। স্থানীয় মানুষজন জানাচ্ছেন, “এতদিনে মনে হচ্ছে, আবার গ্রামে ধর্ম ফিরে এসেছে।” ছোট ছোট বাচ্চারা মায়ের হাত ধরে এসে প্রসাদ নিচ্ছে, পূজোর দিনগুলোয় জমছে উৎসব – সব মিলিয়ে এক প্রাণের স্পন্দন ফিরে এসেছে বেগুটে।স্থানীয় শিক্ষক দীপ্তেন্দু চক্রবর্তী বললেন, “এই জমি শুধু শিব ঠাকুরের নয়, এই গ্রামবাসীর বিশ্বাস, আবেগ আর ঐতিহ্যের প্রতীক। এটা ফিরে পাওয়া মানে আমরা নিজেদের শিকড়ে ফিরে গেছি।” আবার বয়স্ক কৃষক গোপাল ঘোষ বললেন, “পূজোর দিনে এখন মনটা শান্ত লাগে। এত বছর পরে আবার যেন শিব ঠাকুর নিজে ফিরে এলেন।”এই ঘটনাটি শুধু একটি গ্রামে ধর্মীয় জমি পুনরুদ্ধার নয় – এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যদি মানুষ সচেতন হন, ঐক্যবদ্ধ হন, তবে প্রশাসনের দরজায় না গিয়েও অনেক অন্যায়ের প্রতিকার সম্ভব। এটি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের মাধ্যমে পাওয়া এক অসাধারণ সামাজিক সাফল্য।এখন প্রশ্ন উঠছে—এই উদ্যোগ কি অন্য গ্রামের জন্যও উদাহরণ হতে পারে? আইনজ্ঞ কৌশিক দে জানালেন, “যে কোনও দেবোত্তর সম্পত্তি যদি বেআইনিভাবে দখল হয়ে যায়, এবং যথাযথ নথিপত্র থাকে, তবে স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেরাই আইনি পথ অবলম্বন করে তা ফিরিয়ে আনতে পারেন। তবে সব কিছুতেই শান্তি ও নিয়ম মেনে চলাটাই মূল কথা।”শেষমেশ, এই বেগুট গ্রামের শিব ঠাকুরের জমি পুনরুদ্ধারের এই গল্পটা একটাই কথা বলে — হার মানলে হার, কিন্তু যদি বিশ্বাস থাকে, ইতিহাস বদলাতেও সময় লাগে না।