Science triumphs in Switzerland, trains will run on solar power!: বিশ্ব যখন পরিবেশবান্ধব শক্তির দিকে ঝুঁকছে, তখন ইউরোপের ছোট্ট পাহাড়ি দেশ সুইজারল্যান্ড এক দারুণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। বাড়ির ছাদে নয়, এবার রেললাইনের ফাঁকা জায়গায় বসানো হচ্ছে সোলার প্যানেল, যার মাধ্যমে উৎপাদিত সৌরশক্তি ব্যবহার করে চলবে ট্রেন! শুনতে যতটা অভিনব লাগছে, বাস্তবে ততটাই বৈপ্লবিক এই উদ্যোগ। এমনকি প্রথম পর্যায়ে এই সৌরশক্তি রেলের পরিকাঠামোতেই সরবরাহ করা হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। এটি শুধুমাত্র পরিবেশের জন্যই নয়, আগামী দিনে গোটা পৃথিবীর পরিবহন ব্যবস্থার ওপর বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।
এই পাইলট প্রকল্পের নাম “Sun-Ways”, যার সূচনা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের লসান ও বার্ন শহরের মধ্যবর্তী রেলপথে। এখানে এক ধরনের বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে রেললাইনের মাঝের ফাঁকা জায়গায় বসানো হচ্ছে ফোল্ডেবল সোলার প্যানেল। সংস্থা সূত্রে খবর, প্যানেল বসানোর প্রক্রিয়াটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে কোনো ট্রেন চলাচলে ব্যাঘাত না ঘটে, আবার প্যানেলগুলিও সহজেই খোলা ও বন্ধ করা যায় – যেন একটা বিশাল ‘রোলার ব্লাইন্ড’ রেললাইনের ওপর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।এই প্রকল্পের প্রযুক্তিগত দিকটি আরও মজার। প্রতিটি সোলার প্যানেল থেকে উৎপন্ন হওয়া ফটোভলটাইক বিদ্যুৎ (Photovoltaic Current) তিনটি ধাপে ব্যবহার করা যাবে। প্রথমত, সরাসরি রেলের বিভিন্ন পরিকাঠামো যেমন সিগন্যাল সিস্টেম, স্টেশন লাইটিং, এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিন যন্ত্রে এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে। দ্বিতীয়ত, রেললাইনের কাছাকাছি থাকা জিআরডি স্টেশন (Grid Relay Distribution)-এ সংযুক্ত করে স্থানীয়ভাবে এই শক্তি ব্যবহার করা যাবে। তৃতীয়ত, ভবিষ্যতে বড় মাপের সংযুক্তি হলে সম্পূর্ণ ট্রেন চলাচলের শক্তির উৎস হিসেবেও সৌরশক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।‘Sun-Ways’ সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী বেঞ্জামিন কোহেন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “রেলপথের মধ্যবর্তী যে বিশাল জায়গা ব্যবহারহীন পড়ে থাকে, সেটিকে যদি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাজে লাগানো যায়, তবে তা হবে এক বিশাল সাফল্য। ৫৩২০ কিলোমিটার রেলপথে প্যানেল বসালে বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব – যা প্রায় ৩ লক্ষ পরিবারের চাহিদা মেটাতে সক্ষম।”এই প্রকল্পের পেছনে রয়েছে পরিবেশগত দায়বদ্ধতা। সুইজারল্যান্ড এমনিতেই কার্বন নির্গমন হ্রাসে অগ্রণী দেশ। কিন্তু এই উদ্যোগ শুধু দেশীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না বলেই আশা করা যাচ্ছে। ইউরোপের বহু দেশ যেমন ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ইতিমধ্যেই এই মডেল অনুসরণের আগ্রহ দেখিয়েছে। ভারতের মতো দেশে যেখানে রেলওয়ে দেশের সবচেয়ে বড় পরিবহন ব্যবস্থাগুলোর একটি, সেখানে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ হলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রযুক্তি পরিবেশের জন্য যেমন উপকারী, তেমনই এটি অর্থনৈতিক দিক থেকেও সাশ্রয়ী হবে। দীর্ঘমেয়াদে রেলের বিদ্যুৎ খরচ কমবে এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে। একইসঙ্গে, কর্মসংস্থান তৈরি হবে বিভিন্ন স্তরে – প্রযুক্তি, নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ সহ নানা বিভাগে।পরিবেশবিদ ডঃ এলিনা হার্টম্যান এই উদ্ভাবনকে “একবিংশ শতাব্দীর গেম চেঞ্জার” হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, “এটা প্রমাণ করে দিল পরিবহন ব্যবস্থাও শতভাগ টেকসই হতে পারে যদি ইচ্ছাশক্তি ও সঠিক পরিকল্পনা থাকে। এই প্রকল্প বিশ্বজুড়ে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করবে।”সাধারণ মানুষদের প্রতিক্রিয়াও বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে বলছেন, “যেখানে একদিকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং আমাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করছে, সেখানে এমন এক উদ্যোগ নতুন আশার আলো।”সুইজারল্যান্ড সরকার জানিয়েছে, যদি পাইলট প্রকল্প সফল হয় তবে পরবর্তী ধাপে বৃহৎ পরিসরে সমস্ত দেশে এই মডেল রূপায়ণ করা হবে। এমনকি এই প্রযুক্তি উন্নয়ন ও রপ্তানির জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহও ইতিমধ্যে দেখা গিয়েছে।তবে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকছেই। যেমন – তুষারপাত প্রবণ এলাকায় প্যানেলের কার্যকারিতা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এছাড়া ট্রেন চলাকালীন যে কম্পন ও কাঁপুনি হয়, তা প্যানেলগুলোর স্থায়িত্বে কোনও প্রভাব ফেলবে কিনা, তা-ও পর্যবেক্ষণাধীন। তবে এই সমস্যাগুলো প্রযুক্তিগত উপায়ে সমাধান করার রাস্তাও তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংস্থা।সুইজারল্যান্ডের এই পদক্ষেপ শুধু বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির জয় নয়, এটি পৃথিবীর প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতার নিদর্শন। ট্রেন এখন আর শুধু যাত্রার মাধ্যম নয়, আগামী প্রজন্মের টেকসই ভবিষ্যতের বাহক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করছে। আর এই পথে রেললাইনের ফাঁকা জায়গাতেই উঁকি দিচ্ছে নতুন সূর্য – সোলার ট্রেনের সূর্য!