India completely stops imports from Pakistan: পাহেলগামের সেই বিভীষিকাময় সকালের কথা আজও দেশের মানুষ ভুলতে পারেননি, যখন জম্মু-কাশ্মীরের বৈসরান উপত্যকায় ভয়ঙ্কর জঙ্গি হানায় প্রাণ হারান ২৬ জন নিরীহ মানুষ, যাঁদের মধ্যে ছিলেন এক নেপালি পর্যটক এবং স্থানীয় এক ঘোড়াচালকও। তদন্তে উঠে আসে, এই হামলার পিছনে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠীর নাম। এর পর থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের একের পর এক সিদ্ধান্ত যেন স্পষ্ট করে দিচ্ছে—ভারত এবার আর শুধু নিন্দা নয়, কার্যত চূড়ান্ত প্রত্যাঘাতের রাস্তায় হাঁটছে। কেন্দ্রের বাণিজ্য মন্ত্রকের তরফে বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানানো হয়েছে, পাকিস্তান থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডে কোনও রকম পণ্য—তা সরাসরি হোক বা অন্য কোনও দেশের মাধ্যমে ঘুরপথে—আমদানি একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এবং কোনও ব্যতিক্রম ঘটলে, তাও শুধুমাত্র সরকারের আগাম লিখিত অনুমোদনেই সম্ভব হবে। ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে ওয়াঘা-অটারি সীমান্তের একমাত্র বৈধ বাণিজ্য পথ, যা এতদিন সীমিত হলেও চালু ছিল।
এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রথমত ধাক্কা খেতে চলেছে দুই দেশের মধ্যে থাকা সামান্য যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখনো বেঁচে ছিল। যদিও সরকারী হিসেবে দেখা গেছে, পাকিস্তান থেকে ভারতের মোট আমদানি ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের জেরে প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এবং ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে তা ভারতের মোট আমদানির মাত্র ০.০০০১ শতাংশেও পৌঁছায়নি। তথাপি এই সিদ্ধান্ত কূটনৈতিক স্তরে একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়—সন্ত্রাস মদতদাতার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক নয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ইতিমধ্যেই স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, “কাশ্মীর থেকে সন্ত্রাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও রকম বাণিজ্য আলোচনা বা সংলাপ হবে না।”
এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানও চুপ করে বসে নেই। তারা পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ভারত যদি ১৯৬০ সালের ইন্দাস জলচুক্তি বাতিল করে দেয় বা জলপ্রবাহ আটকে দেয়, তাহলে তারা সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাতিল করতে পারে। ইতিমধ্যেই সীমান্তে বাড়ছে উত্তেজনা, LOC বরাবর গুলি বিনিময় বাড়ছে বলে সেনা সূত্রে খবর। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকেও একাধিকবার অভিযোগ তোলা হয়েছে যে ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে কূটনৈতিক ও মানবিক পরিসর সংকুচিত করছে।
এই কঠোর পদক্ষেপের প্রভাব কেবল কূটনৈতিক বা সীমান্ত রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এর অর্থনৈতিক দিকও আছে। যেমন ধরুন, দক্ষিণবঙ্গে সম্প্রতি যে নতুন চা বাগান তৈরি হচ্ছে, যা নিয়ে প্রবল উৎসাহ ছড়িয়েছে ব্যবসায়ী মহলে ও পর্যটন শিল্পে, তাতে কাঁচামাল ও বাণিজ্যিক যন্ত্রাংশ সরবরাহে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। কারণ এই ধরণের বড় চা প্রকল্পের জন্য বহু উপকরণ বিদেশ থেকে আসে, যার মধ্যে কিছু চীনের মাধ্যমে ঘুরপথে পাকিস্তানের পণ্য হিসেবেও থাকতে পারে। এবার সেই সরবরাহ চেইনও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এই প্রসঙ্গে ‘খাবর বাংলা’র পক্ষ থেকে কথা হয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার নয়া চা বাগান প্রকল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা রাজু ঘোষের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরেই চাইছিলাম দক্ষিণবঙ্গে একটা বিকল্প চা অঞ্চল তৈরি হোক যাতে শুধু দার্জিলিং নয়, বাকি রাজ্যও লাভবান হয়। কিন্তু হঠাৎ করে যদি আমদানি নিষিদ্ধ হয়, কিছু সরঞ্জামের বিকল্প খুঁজতে সময় লাগবে। তবে আমরা আত্মনির্ভর হতেই চাই। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি।” জানা গেছে, দক্ষিণবঙ্গের এই চা বাগান প্রকল্পে স্থানীয় বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে, বিশেষ করে সুন্দরবন ও সাগর দ্বীপ এলাকার যুব সম্প্রদায়ের।
অন্যদিকে, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা হলেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কলকাতা চেম্বার অফ কমার্সের এক সদস্য বললেন, “ভারত-পাকিস্তান বাণিজ্য এমনিতেই ন্যূনতম পর্যায়ে ছিল। তবু এই সিদ্ধান্ত দক্ষিণ এশিয়ার জিও-ইকোনমিক স্থিতিশীলতায় বড় বার্তা পাঠাবে। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সংযুক্ত উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে কিছু প্রোডাক্ট ভারতের বাজারে এসেছিল, যা এখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।” তবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অরবিন্দ বসু মনে করছেন, “এই পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদে ভারতের পক্ষেই যাবে। আমরা নিজের দেশেই পর্যাপ্ত উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছি।”
এছাড়া চিকিৎসা ভিসা ও সাধারণ ভিসাও বাতিল করা হয়েছে, ফলে ভারতে অবস্থানরত সমস্ত পাকিস্তানি নাগরিককে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসার জন্য আগত বহু পাকিস্তানি রোগীর ভবিষ্যত অনিশ্চিত। দিল্লির এক নামজাদা হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. প্রীতম সেন জানালেন, “আমাদের হাসপাতালে কিছু রোগী ছিল যারা পাকিস্তান থেকে এসেছিল চিকিৎসার জন্য। এখন তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তবে সরকার যদি মানবিক কারণে কিছু ব্যতিক্রম রাখে, তা হলে ভালো হয়।”
সবমিলিয়ে এটা পরিষ্কার যে দিল্লির কড়া সিদ্ধান্ত কেবল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াই নয়, দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত রূপরেখারই অংশ। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের জিরো টলারেন্স পলিসি যেমন আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসা কুড়োচ্ছে, তেমনই দেশীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থেও এই ধরণের সিদ্ধান্ত একপ্রকার বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোন পথে যাবে, তা এখন সময়ই বলবে। তবে আপাতত দক্ষিণবঙ্গের নতুন চা বাগান প্রকল্প থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথ—সব ক্ষেত্রেই সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।