Now tea gardens in South Bengal!:-যখনই চা বাগানের কথা ওঠে, চোখে ভেসে ওঠে পাহাড়ি ঢালের ধাপে ধাপে সাজানো দার্জিলিং বা কালিম্পঙের চা বাগান, কুয়াশায় মোড়া সবুজ চাদরে ঢাকা উপত্যকা, আর তার মাঝখানে শ্রমিকদের ব্যস্ততা। কিন্তু এবার সেই দৃশ্য দেখতে উত্তরবঙ্গে যেতে হবে না—চা গাছের সবুজ পাতার ছোঁয়া মিলবে আমাদের দক্ষিণবঙ্গেও। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও, সত্যিই এবার হাওড়ার শিবপুরে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু উদ্ভিদ উদ্যানেই গড়ে উঠছে এক চমকপ্রদ চা বাগান। ইতিহাস যেন ফিরে এসেছে তার পুরনো ঠিকানায়। ১৮২৩ সালে ব্রিটিশ আমলে এই উদ্যানেই প্রথম চা গাছ লাগানো হয়েছিল গবেষণার উদ্দেশ্যে, আর সেই পথ ধরেই পরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে চা চাষ। শতাব্দী পেরিয়ে আবার সেই একই উদ্যানে ফিরে এল সেই চা গাছ। উদ্যানের অধিকর্তা দেবেন্দ্র সিং জানিয়েছেন, “এই গরমে চা গাছ বাঁচানো আমাদের কাছে খুব বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

তবে বিজ্ঞান ও শ্রমের সমন্বয়ে তা সফল হয়েছে। মাটির ধরন বদলে, ঢালু জমি তৈরি করে এবং বড় গাছের ছায়ায় চারা গুলি লাগানো হয়েছে যাতে গরম থেকে রক্ষা পায়।” এখন ওই বাগানে একের পর এক চা গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। জায়গাটি পড়েছে গ্রেট ব্যানিয়ান ট্রির উল্টোদিকে। তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় পাহাড়ি অঞ্চলের মতো পরিবেশ তৈরির চেষ্টা হয়েছে—এতে মাটির গঠন পরিবর্তন, জল নিকাশির ব্যবস্থা এবং উপযুক্ত ছায়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে চারা বাঁচে। এই উদ্যোগ শুধু কৃষিবিজ্ঞানী বা উদ্যান কর্তৃপক্ষের নয়, সাধারণ মানুষ, ছাত্রছাত্রী ও পর্যটকদের কাছেও এক নতুন আকর্ষণের কেন্দ্র হতে চলেছে। অনেক পর্যটকই বলেন, “শুধু গাছের বৈজ্ঞানিক দিক না, এটা ইতিহাসের স্পর্শ, একটা জীবনযাত্রার সঙ্গে আমাদের সংযোগ।”
এক অভিভাবক জানালেন, “আমার ছেলে প্রাণীবিদ্যা পড়ে, ওকে নিয়ে ছুটির দিনেই এখানে আসব। এই ধরনের প্রকল্প আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রকৃতি ও তার ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় করায়।” পরিবেশবিদদের একাংশ মনে করছেন, দক্ষিণবঙ্গে চা চাষের পরীক্ষামূলক এই প্রয়াস ভবিষ্যতের কৃষিপ্রযুক্তির এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। কারণ দক্ষিণের জলবায়ু ও মাটির গঠন একেবারেই আলাদা উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি অঞ্চলের তুলনায়। সফল হলে হাওড়া-হুগলির বিস্তীর্ণ কিছু উঁচু জমিতে বিশেষ প্রযুক্তি প্রয়োগ করে চা চাষকে বিকল্প আয়ের উৎস করে তোলা যেতে পারে। স্থানীয় মানুষদের মধ্যেও উচ্ছ্বাস স্পষ্ট। শিবপুর এলাকার এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, “বহু বছর ধরে আমরা এই উদ্যানকে শুধু ফুলগাছের উদ্যান বলেই জেনে এসেছি, এখন এটা চা বাগানের জন্য বিখ্যাত হবে ভাবতেই ভালো লাগছে।” পর্যটকদের ভিড়ও ধীরে ধীরে বাড়ছে। অনেকেই বলছেন, “এই বাগান শুধু ঘোরার জায়গা নয়, শেখার জায়গা।

শিশু থেকে প্রবীণ—সবাই কিছু না কিছু শিখে ফিরছে।” উদ্যান কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনা করছে এই চা বাগানকে কেন্দ্র করে একটি প্রদর্শনী করানোর, যেখানে দেখানো হবে কীভাবে চা গাছ বড় হয়, কীভাবে চা প্রক্রিয়াকরণ হয়, এবং চা বাগানের ইতিহাস। এই নতুন উদ্যোগকে ঘিরে ব্যবসায়িক সম্ভাবনাও দেখা দিচ্ছে। হাওড়ার স্থানীয় কিছু উদ্যোক্তা ইতিমধ্যেই চিন্তাভাবনা করছেন ছোট আকারে প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট গড়ে তোলার। আবার অনেকেই পর্যটকদের জন্য হাতে তৈরি অর্গানিক চা প্যাকেট বিক্রির ভাবনাতেও এগিয়ে এসেছেন। এই প্রকল্পের সফলতা প্রমাণ করতে পারলে রাজ্যের কৃষি বিভাগও এই প্রকল্পের সম্প্রসারণে উৎসাহ দেখাতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এই রকম ইনোভেটিভ চাষ পদ্ধতি ভবিষ্যতের জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রস্তুতি হিসেবেও কাজ করবে।” তবে, সব কিছুর মাঝে একটি বড় বার্তা থেকে যায়—চা গাছ শুধু একটি অর্থকরী ফসল নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, এবং প্রকৃতির সঙ্গে এক আন্তরিক সংযোগ। শিবপুর উদ্যানের এই চা বাগান সেই সংযোগেরই জীবন্ত উদাহরণ। আজকের শিশু, আগামী দিনের গবেষক, পরিবেশপ্রেমী অথবা সাধারণ প্রকৃতিপ্রেমী—সবার কাছেই এটি হয়ে উঠতে পারে এক অনুপ্রেরণার জায়গা। আমরা যারা এতদিন ভাবতাম চা বাগান মানেই দার্জিলিং, তারা এবার গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, “দক্ষিণেও আছে আমাদের নিজস্ব চা বাগান!”