UK driverless truck makes first successful long-distance journey : যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস রাজ্যে সম্প্রতি ঘটে গেলো এমন একটি ঘটনা, যা ভবিষ্যতের পরিবহন ব্যবস্থাকে একেবারে বদলে দিতে পারে। ডালাস থেকে হিউস্টনের মাঝখানে প্রায় ১২০০ মাইল দীর্ঘ এক রাস্তা পেরিয়ে প্রথমবারের মতো সফলভাবে বাণিজ্যিকভাবে চললো একটি চালকবিহীন ট্রাক। হ্যাঁ, কোনও মানুষ ছাড়াই— না ছিল চালক, না সহচালক, এমনকি ‘সেফটি ড্রাইভার’ পর্যন্ত নয়। ট্রাকটি তৈরি করেছে একটি স্টার্টআপ সংস্থা, যার নাম Aurora Innovation Inc.। এই সংস্থাটি মূলত স্বচালিত গাড়ির প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে এবং বর্তমানে Uber Freight এবং Hirschbach Motor Lines এর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। যেদিন থেকে এই পরীক্ষা শুরু হয়, তখন গাড়ির ভেতরে একজন ‘সুরক্ষা চালক’ রাখা হতো, যাতে কোনও সমস্যা হলে সে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু এবার যে সফল ট্রিপ হয়েছে, তাতে এমন কাউকেই রাখা হয়নি। সম্পূর্ণরূপে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত, ক্যামেরা, সেন্সর এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ওপর নির্ভর করেই এই ট্রাকটি তার গন্তব্যে পৌঁছায়।

এই ঘটনা শুধুই প্রযুক্তির অগ্রগতি নয়, বরং এটি আমাদের সমাজ, শ্রম বাজার এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে চলেছে। যেমনটা বলছিলেন Chris Urmson, অরোরার সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও: “আমরা মনে করি এটা একটি মাইলফলক। শুধু একটি ট্রাক চালানো নয়, বরং নিরাপদ, দক্ষ ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে এটি আমাদের বড় পদক্ষেপ।” তবে সবাই এতটা আশ্বস্ত নন। ট্রাকচালকদের প্রতিনিধিত্বকারী শ্রমিক ইউনিয়নগুলো যেমন Teamsters Union, তারা বলছেন— “এটা শুধু একটা ট্রাক নয়, এটা হাজার হাজার মানুষের জীবিকার হুমকি।” এক ট্রাকচালক, Tom Rodriguez, যার বয়স প্রায় ৫৫, ৩০ বছর ধরে ট্রাক চালান, তিনি বলেন— “আমি তো অবসর নিতে চলেছি। কিন্তু আমার ছেলে যে ট্রাকচালক হতে চায়, তার ভবিষ্যত কোথায়?”
এই প্রশ্নটাই এখন সবচেয়ে বড়। কারণ একদিকে যেমন মানুষহীন ট্রাক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমিয়ে আনতে পারে, ক্লান্তি বা ঘুমে চোখ বন্ধ হওয়ার ভয় নেই, তেমনি অন্যদিকে এই প্রযুক্তি চাকরি কেড়ে নিতে পারে লাখ লাখ ট্রাকচালকের। তবে সবটাই কি ভয় আর হতাশা? না, মোটেও না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠবে নতুন কাজের ক্ষেত্র। যেমন, ট্রাক রক্ষণাবেক্ষণ, সফটওয়্যার আপডেট, রিমোট মনিটরিং, নিরাপত্তা বিশ্লেষণ— এসব কিছু করতে মানুষ লাগবেই। অর্থাৎ, কেউ হয়তো স্টিয়ারিং-এ বসবে না, কিন্তু সার্ভারে বা কন্ট্রোল রুমে তো হতেই হবে কেউ।
একজন প্রযুক্তি বিশ্লেষক, Linda Matthews, যিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে রোবোটিক্স বিভাগে কাজ করেন, বললেন— “এটি প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ। ২০২৫ সালের মধ্যে এমন বহু ট্রাক রাস্তায় দেখা যাবে। তবে এর সফলতা নির্ভর করবে কতটা নিরাপদে এগুলো চলে এবং সমাজ কীভাবে মানিয়ে নেয় তার ওপর।” এই ট্রাকগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে LIDAR, RADAR, ক্যামেরা সেন্সর, এবং একটি সুগঠিত AI সিস্টেম, যা প্রতিটি সিগন্যাল, বাঁক, গাড়ি বা হঠাৎ বাধা—সবকিছুকে তৎক্ষণাৎ বিশ্লেষণ করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়। পুরো জার্নিটিই সরাসরি মনিটর করা হয় কোম্পানির ডেটা সেন্টার থেকে।
এই যাত্রার শুরু ডালাসের Aurora Hub থেকে। ট্রাকটি পণ্য নিয়ে হিউস্টনের একটি বাণিজ্যিক গুদামে পৌঁছে যায় মাত্র কয়েক ঘণ্টায়, কোন দুর্ঘটনা ছাড়াই। আরও বিস্ময়ের বিষয়, এই পুরো ভ্রমণে কোনো পুলিশ বা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের হস্তক্ষেপও লাগেনি। এমনকি হিউস্টনের হাইওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে— “ট্রাকটি একবারও আইন ভাঙেনি। বরং সেটি অন্য চালকদের তুলনায় বেশি নিয়ম মানছিল।” এই তথ্য আমাদের প্রযুক্তির প্রতি বিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে।
তবে সাধারণ মানুষের মনেও রয়েছে কিছু উদ্বেগ। হিউস্টনের এক সাধারণ গৃহবধূ Maria Lopez বলেন— “আমার বাসার পাশ দিয়েই ওই ট্রাক গেছে। আমার ছোট বাচ্চা রাস্তা পার হচ্ছিল, আমি ভীষণ চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু পরে জানলাম, ওই ট্রাক আসলে আমার ছেলের গতিবিধিও বুঝে রাস্তা ফাঁকা না হওয়া পর্যন্ত থেমে ছিল।” এ ঘটনা জানার পর অনেকের মনেই একধরনের আস্থা তৈরি হয়েছে, আবার কেউ কেউ বলছেন, “টেকনোলজি তো ভালো, কিন্তু মানুষ ছাড়া কিছু একটা রাস্তায় চলবে, ভাবতেই ভয় লাগে!”
বিশ্বজুড়ে এখন এমন চালকবিহীন প্রযুক্তি নিয়ে নানা দেশ কাজ করছে। জার্মানি, চীন, এবং জাপান ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ছোট রাস্তা বা হাইওয়েতে স্বচালিত ট্রাকের পরীক্ষা চালাচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এই বাণিজ্যিক সফর ছিল প্রথম এবং এত বড় মাপের। Aurora বলেছে, তারা আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে আরও ২০টি ট্রাক এই পথে চালাবে এবং ধীরে ধীরে অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে দেবে। তারা চায়— ভবিষ্যতের হাইওয়ে হোক চালকহীন, দুর্ঘটনাহীন, এবং একেবারে ফিউচারিস্টিক।
এই মুহূর্তে প্রশ্ন একটাই— এই ট্রাক যদি সফল হয়, তাহলে কি সত্যিই আমাদের সমাজে নতুন এক প্রযুক্তিভিত্তিক বিপ্লব আসবে? নাকি চাকরি হারানোর ভয়ে মানুষ এটাকে রুখে দাঁড়াবে? সময়ই উত্তর দেবে। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার— এই চালকবিহীন ট্রাক শুধু রাস্তা নয়, চালিয়ে দিয়েছে আমাদের চিন্তার দিকও। কোথায় যাচ্ছি আমরা? কেমন হবে ভবিষ্যৎ পরিবহন ব্যবস্থা? এই গল্প এখনও চলবে… হয়তো ট্রাক ছাড়াই।