Kashmir terror attack:কাশ্মীর, একসময় যেখানে শুধুই প্রকৃতির সৌন্দর্য ও শান্তির ছোঁয়া মেলে, আজ সেখানে আবার বেজে উঠল রক্তের দামামা। অনন্তনাগ জেলার পহেলগাঁওয়ের বৈসরণ উপত্যকায় মঙ্গলবার সকালে ঘটে গেল এমন এক ভয়াবহ জঙ্গি হামলা, যা শুধু উপত্যকাকে নয়, নাড়া দিয়েছে গোটা দেশকে। ঘটনাটি যখন ঘটেছে, তখন বৈসরণ ঘাসের উপত্যকায় ছুটি কাটাতে এসেছিলেন দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক। কেউ ঘোড়ার পিঠে চড়ে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাচ্ছিলেন, কেউ মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করছিলেন পাহাড়ি রূপ। ঠিক তখনই, আচমকা ২-৩ জন জঙ্গি হানা দেয় সেখানে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, কিছু বোঝার আগেই শুরু হয় এলোপাথারি গুলিবর্ষণ। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যেই। প্রত্যক্ষদর্শী এক মহিলা জানান, “আমি ভেলপুরি খাচ্ছিলাম। হঠাৎ এক জঙ্গি এসে আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোন ধর্মের?’, উত্তর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওঁকে গুলি করে দেয়।” এই বয়ান শুনে বোঝা যায়, হামলাটি শুধু পরিকল্পিতই নয়, ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূতও বটে। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, হামলায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ২০ জনের, আহত হয়েছেন ৩০-এরও বেশি মানুষ। এর মধ্যে ১৬ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গিয়েছে। আহতদের মধ্যে রয়েছেন বিদেশি পর্যটকরাও। হসপিটালে ভর্তিকৃতদের চিকিৎসা চলছে কড়া নজরদারির মধ্যে। স্থানীয় এক নিরাপত্তাকর্মী জানান, “এত ভয়াবহ দৃশ্য এর আগে দেখিনি। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল উপত্যকা, মানুষ দৌঁড়াচ্ছে প্রাণে বাঁচতে, কেউ চিৎকার করছে, কেউ মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে।”

ঘটনার পরপরই এলাকায় মোতায়েন করা হয় বিশাল সেনা ও নিরাপত্তাবাহিনী। গোটা বৈসরণ এলাকা ঘিরে ফেলা হয়। শুরু হয়েছে চিরুণি তল্লাশি। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো জঙ্গিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ঘটনায় তদন্তভার তুলে দেওয়া হয়েছে NIA-এর হাতে। রাতেই কাশ্মীরে পৌঁছে গিয়েছে NIA-এর একটি বিশেষ তদন্তকারী দল। তাদের সঙ্গে রয়েছেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরাও। কড়া নিরাপত্তায় চলছে প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ, ভিডিও ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে, স্থানীয়দের তথ্য নেওয়া হচ্ছে। গোটা দেশ যখন এই ঘটনায় স্তম্ভিত, তখন সৌদি আরবে সফররত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক্স হ্যান্ডেলে শোক প্রকাশ করে বলেন, “কাশ্মীরে নিরীহ পর্যটকদের উপর এই কাপুরুষোচিত হামলা নিন্দনীয়। যারা এই ঘটনার পিছনে আছে, তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।” এর পরই তিনি ফোনে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে। জানা গেছে, রাতেই কাশ্মীরে পৌঁছেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, কাশ্মীরের প্রতিটি হাই-রিস্ক ট্যুরিস্ট লোকেশনে নিরাপত্তা জোরদার করা হবে।

জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের এক সিনিয়র অফিসার বলেন, “এটা একদম স্পষ্ট যে, পর্যটনকে লক্ষ্য করেই এই হামলা চালানো হয়েছে। কাশ্মীরের অর্থনীতির একটা বড় অংশ পর্যটনের উপর নির্ভর করে। এই হামলা সেই অর্থনীতিকেও ধাক্কা দিল।” সত্যিই, বৈসরণ এমন এক জায়গা, যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক ঘুরতে আসেন। স্থানীয়দের উপার্জনের প্রধান মাধ্যমও এই পর্যটন ব্যবসা। বৈসরণের এক ঘোড়াওয়ালা বলেন, “কালও ওরা আমার ঘোড়া চড়েছিল, হাসিমুখে ছবি তুলছিল। আজ তাদের অনেকেই নেই। আমরা এখন কীভাবে বাঁচব?”
কাশ্মীরের স্থানীয় রাজনীতি থেকেও উঠে এসেছে নানা প্রতিক্রিয়া। PDP নেত্রী মেহবুবা মুফতি বলেছেন, “কাশ্মীরের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে বারবার এই ধরনের হামলা চালানো হচ্ছে। কিন্তু আমাদের একজোট হয়ে এর মোকাবিলা করতে হবে।” অন্যদিকে, বিজেপি মুখপাত্র জানান, “কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা উঠে যাওয়ার পর উপত্যকায় শান্তির বাতাস বইছিল। কিন্তু কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ও পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা সেটা সহ্য করতে পারছে না।”
এই হামলার দায় এখনো কোনো জঙ্গি সংগঠন স্বীকার করেনি, তবে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যাচ্ছে, পাকিস্তান সীমান্তের ওপার থেকে পরিচালিত এক নতুন সংগঠন এই হামলার পিছনে থাকতে পারে। ইতিমধ্যে সেনার তরফে LOC-এ সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সেনাবাহিনীকে হাই অ্যালার্টে রাখা হয়েছে।
এই ভয়াবহ ঘটনার ফলে শুধুমাত্র পর্যটন নয়, স্থানীয় মানুষের জীবনযাপনেও এসেছে ভয়ংকর প্রভাব। অনেকে ইতিমধ্যেই তাঁদের হোটেল বুকিং বাতিল করেছেন। কাশ্মীরের এক হোটেল মালিক জানান, “আমার মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সব বুকিং ছিল। আজ সকাল থেকেই ফোন করে ক্যানসেল করছে সবাই। আর আমাদের এই তিন মাসেই যা রোজগার হয়, তা দিয়েই সারা বছর চলি।”
হামলার তদন্ত এখন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বারবার জানানো হয়েছে, “এই ঘটনার সাথে যারা জড়িত, তাদের কোনোভাবেই রেহাই দেওয়া হবে না।” প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কড়া বার্তা – “দেশের মাটিতে এই ধরনের জঙ্গি কার্যকলাপ বরদাস্ত করা হবে না।”
কাশ্মীর আজ রক্তাক্ত, বৈসরণ আজ স্তব্ধ, কিন্তু গোটা দেশ একসাথে দাড়িয়েছে সেই সব নিরীহ মানুষদের পাশে যারা শুধুমাত্র প্রকৃতির টানে, আনন্দের খোঁজে গিয়েছিলেন ছুটি কাটাতে। এই গল্পগুলো আজ রক্তের অক্ষরে লেখা হয়ে গেল উপত্যকার বুকে।