Protest of jobless people continues at SSC building:এসএসসি ভবনের সামনে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত চলছে এক বিক্ষোভের কাহিনী—চাকরি হারানো শত শত যুবক-যুবতীর বুকফাটা কান্না, নিঃশ্বাসে আশার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ন্যায়বিচারের দাবি। একদিকে যখন শিক্ষা ভবনের সামনে চাকরি হারানো শিক্ষক-শিক্ষিকারা চিৎকার করে বলছেন, “আমরা যোগ্য, তবু কেন ছাঁটাই?”, তখনই করুণাময়ীতে বসে রয়েছেন গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি-র চাকরি প্রার্থীরা, যাঁদের দাবি—যোগ্য-অযোগ্য তালিকা প্রকাশ হোক অবিলম্বে। যেন দুই জায়গায় দুই লড়াই, কিন্তু লক্ষ্য একটাই – স্বচ্ছতা, ন্যায় এবং বেঁচে থাকার অধিকার। সোমবার দুপুর থেকে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ এখনো চলছেই, এবং প্রতিবাদের ধারা যেন ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে এক বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে।
এসএসসি কেলেঙ্কারি, যা একসময় সংবাদপত্রের শিরোনামে ছিল কেবল রাজনৈতিক বিতর্কের রসদ হিসেবে, এখন তা রূপ নিয়েছে বাস্তব জীবন যুদ্ধে – যেখানে একদিকে চাকরি পাওয়ার পর হঠাৎ ছাঁটাই হওয়া তরুণরা জীবনধারণের লড়াইয়ে রাস্তায় বসে রয়েছেন, আর অন্যদিকে যাঁরা এখনও চাকরি পাননি, তাঁরা আবেদন করছেন স্বচ্ছ নিয়োগের আশায়। গায়ে জ্বরে কাঁপা, চোখে ক্লান্তির ছাপ, অনেকেই না খেয়ে বসে আছেন আন্দোলনে, অনেকে আবার প্ল্যাকার্ডে লিখে এনেছেন—”আমার অপরাধ কি আমি বেকার?”। এক প্রাক্তন শিক্ষক বলেন, “চাকরিটা শুধু একটা কাজ না, এটা ছিল আমার পরিচয়, আমার আত্মসম্মান। এখন মনে হয় সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি।” এমন বহু গল্প বয়ে চলেছে প্রতিদিন এসএসসি ভবনের সামনে, যেন প্রতিটি মুখে এক একটি উপন্যাস।
দীর্ঘদিন ধরে এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার তদন্ত করছে সিবিআই, একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহ এসএসসি বোর্ডের শীর্ষ আধিকারিকরাও। এই তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে বহু নিয়োগ বাতিল হয়েছে, কোর্টের নির্দেশে একাধিক তালিকা তৈরি হয়েছে যেখানে ‘যোগ্য’ ও ‘অযোগ্য’ বলে ভাগ করা হয়েছে প্রার্থীদের। কিন্তু এই তালিকা প্রকাশে যেভাবে গড়িমসি চলছে, তাতে সাধারণ প্রার্থীরা আরও অসহায় হয়ে পড়ছেন। আন্দোলনকারীরা বলছেন, “একদিকে কোর্ট বলছে তালিকা প্রকাশ করতে, কিন্তু সরকার তা কার্যকর করছে না। তাহলে আমরা কোথায় যাব?”
এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে উঠে এসেছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক – মানসিক স্বাস্থ্য। বহু প্রার্থী দীর্ঘদিন ধরে বেকার অবস্থায় থাকায় অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন, কেউ কেউ আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন, কেউ কেউ আবার প্রতিবাদের মধ্যে থেকেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। শিক্ষাবিদ ডঃ অনুরাধা সেন বলেন, “এই পরিস্থিতি শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি এক মানবিক সঙ্কট। যেখানে তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে অবহেলা চলছে, সেখানে গোটা সমাজকেই জবাবদিহি করতে হবে।”
এদিকে করুণাময়ীতে গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি প্রার্থীরা যাঁরা এখনো নিয়োগের আশায় অপেক্ষা করছেন, তাঁদের বক্তব্য, “আমাদের কাগজপত্র ঠিকঠাক, কিন্তু এখনো ডাকা হচ্ছে না। বারবার বলছি, যোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করুন। স্বচ্ছতা থাকলে আমরা নিজে থেকেই সরে যাব, কিন্তু অন্ধকারে বসে থাকা আর পারছি না।” এক আন্দোলনকারী মহিলা বলেন, “তিন বছর ধরে স্বপ্ন দেখেছি, দিনরাত পড়াশোনা করেছি, পরিবারের স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছি। আজ সব ধূলিসাৎ।”
সামাজিক মাধ্যমেও এই আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি বাড়ছে। বহু নাগরিক, ছাত্র সংগঠন, সাধারণ মানুষ ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম-এ ভিডিও শেয়ার করছেন, আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিচ্ছেন। হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করছে #JusticeForSSCStudents, #SSCProtest, #WeWantJustice। ইউটিউবে বিভিন্ন চ্যানেলে লাইভ চলেছে আন্দোলনস্থল থেকে, সংবাদমাধ্যমের অনেকে প্রতিদিনের আপডেট দিচ্ছেন আন্দোলনের।
এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী? অনেকেই বলছেন, যতক্ষণ না যোগ্য-অযোগ্য তালিকা প্রকাশ হচ্ছে, এবং যোগ্যরা আবার চাকরিতে ফিরছেন কিংবা যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ শুরু হচ্ছে, ততক্ষণ আন্দোলন থামবে না। একটি বড় প্রশ্ন হল, সরকার কি এই সমস্যা সমাধানে আন্তরিক? শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু অবশ্য সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, “আমরা কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করছি। সকলের কাছে ন্যায়বিচার পৌঁছানোর জন্য আমরা চেষ্টা করছি।” তবে আন্দোলনকারীরা এই বক্তব্যে সন্তুষ্ট নন।
সবশেষে বলা যায়, এসএসসি ভবনের সামনে এই আন্দোলন কেবল কয়েকজন তরুণ-তরুণীর চাকরির জন্য লড়াই নয়, এটি এক বৃহত্তর প্রজন্মের স্বপ্নের, মর্যাদার, ও ভবিষ্যতের লড়াই। যারা এখনও জীবনের শুরুতেই ধাক্কা খেয়েছে, তারা যেন এই আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন করে আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। হয়তো এই দৃঢ়তা, এই সহনশীলতা আর সত্যের ওপর ভরসা একদিন তাদের ফিরিয়ে দেবে সেই সম্মান, যেটা তারা হারিয়েছিল অদৃশ্য দুর্নীতির ধোঁয়াশায়।