Jutlo left teaching to join the army, gaining international recognition:যখন অনেকেই শুধুমাত্র নিজের ভবিষ্যৎ, নিরাপত্তা আর স্থায়িত্বের কথা ভেবে চাকরি বেছে নেন, তখন সেই পথ ছেড়ে এক তরুণ শিক্ষক নিজের মাটিকে, নিজের দেশের মানুষকে, এমনকি বিশ্বের অন্য প্রান্তের বিপন্ন মানুষকেও বাঁচানোর জন্য বেছে নিলেন জীবন-জয়ের এক ঝুঁকিপূর্ণ পথ—সেনাবাহিনী। সেই তরুণই নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের শিবনিবাস গ্রামের অরুণাভ মুখোপাধ্যায়, যিনি আজ আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করলেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে এবং কঙ্গোর জঙ্গলে জীবন হাতে নিয়ে শান্তির পতাকা উড়িয়ে ‘পিসকিপিং মেডেল’ অর্জন করে বিশ্বজোড়া কুর্নিশ কুড়োলেন। অরুণাভ প্রথম জীবনে শিক্ষকতা করতেন, বিদ্যা দিয়ে মানুষ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন, কিন্তু দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ, মানবতার প্রতি টান, আর নিজেকে কিছু বড় কাজের জন্য তৈরি রাখার ইচ্ছেই তাঁকে নিয়ে আসে সেনাবাহিনীর চাকরিতে। বর্তমানে তিনি বিএসএফ-এর হেড কনস্টেবল পদে কর্মরত এবং দিল্লিতে তাঁর পোস্টিং থাকলেও ২০২৪ সালের মে মাসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তরফে ভারতের যে ১৬০ জন বিএসএফ সদস্যকে যুদ্ধবিধ্বস্ত কঙ্গোতে পাঠানো হয়েছিল, তাদের মধ্যেই ছিলেন অরুণাভ, যেখানে তাঁর সহকর্মী হিসেবে ছিলেন আরও ২১ জন মহিলা জওয়ান। কঙ্গো নামের দেশটি বহুদিন ধরেই যুদ্ধের আগুনে পুড়ছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য, জঙ্গি গোষ্ঠীর সন্ত্রাস—সব মিলিয়ে সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবন নরক হয়ে উঠেছে। ঠিক সেই সময় মানবতার এক নতুন আলো হয়ে পৌঁছান অরুণাভরা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর বিশেষ ইউনিটের অংশ হিসেবে তিনি দায়িত্ব পান বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গিদের দখল থেকে মানুষদের মুক্ত করে পুনরায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলা।
অরুণাভের নেতৃত্বাধীন দল কেবল কৌশল নয়, মানবিকতার সঙ্গে কাজ করে, প্রয়োজন হলে হাতে বন্দুক তুলে আত্মরক্ষায় লড়াই করেছেন, আবার কখনও কাঁধে শিশুকে তুলে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন—এই দুই বিপরীত চিত্রই একসঙ্গে তাঁর কাজের মধ্যে উঠে আসে। প্রতিটি মিশনে নিজের দক্ষতা ও সাহসিকতা দিয়ে তিনি দলে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কখনও জঙ্গি ঘাঁটি চিহ্নিত করে অভিযান চালিয়েছেন, কখনও শান্তি স্থাপন করে স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস জিতেছেন। এই পরিশ্রম, এই সাহসিকতা এবং নেতৃত্ব গুণের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রসঙ্ঘ তাঁকে পিসকিপিং মেডেল প্রদান করেছে। এমন এক সময় যখন আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতীয় শান্তিরক্ষীদের অবদান নিয়ে বিশেষ আলোচনা চলছে, তখন একজন শিক্ষক থেকে জওয়ান হয়ে আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত হওয়া অরুণাভ মুখোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণার প্রতীক। অরুণাভ নিজে এই সম্মান পেয়ে জানিয়েছেন, “আমার কাজ করতে গিয়ে আমি শুধু একজন সেনা সদস্য নই, আমি একজন মানুষ, যে কঙ্গোর মাটিতে মানুষের মুখে হাসি ফেরাতে চেয়েছে। এই মেডেল শুধু আমার একার নয়, এই দেশের, আমার পরিবারের, আমার গ্রামের।” তাঁর এই সাফল্যে খুশি গোটা কৃষ্ণগঞ্জ, উচ্ছ্বাসে ভেসেছেন স্থানীয় মানুষজন। গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান জানিয়েছেন, “অরুণাভ শুধু আমাদের গ্রামের নয়, সমস্ত বাংলা ও দেশের গর্ব। আমরা চাই আগামী প্রজন্ম তাঁর পথ অনুসরণ করুক।” অরুণাভের বাবা-মা এখনও শিবনিবাস গ্রামে থাকেন। তাঁরা ছেলের জন্য যেমন গর্বিত, তেমনই উদ্বিগ্নও, কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে ছেলেকে পাঠানো মানে প্রতিদিন এক একটা বিপদের মুখোমুখি হওয়া। কিন্তু তাঁদের মতে, “অন্যের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখত অরুণাভ ছোটবেলা থেকেই। সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব হয়েছে।” শান্তিরক্ষা মিশনে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই অংশগ্রহণ করে আসছে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পিসকিপিং বাহিনী প্রেরণকারী দেশ।

এই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে যেমন রয়েছেন অভিজ্ঞ সেনানায়ক, তেমনই রয়েছেন নতুন প্রজন্মের উৎসাহী তরুণরা, যারা শুধু লড়াই করতে নয়, গঠনমূলক পরিবর্তন আনতেও তৈরি। কঙ্গোতে ভারতীয় বাহিনীর ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, জাতিসংঘের মহাসচিব বারবার প্রশংসা করেছেন তাদের সাহসিকতা ও মানবিকতার জন্য। আর এই বড় সাফল্যের পেছনে থাকে একজন একজন করে নিঃশব্দে কাজ করা মানুষদের প্রচেষ্টা, যেমন অরুণাভ মুখোপাধ্যায়। এই খবর সামনে আসার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এমন অসাধারণ কীর্তি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কেন আরও আগে জানে না? কেন আমরা নিজের দেশের এমন বীর সন্তানদের নিয়ে বেশি গল্প বলি না? কেন আমরা শুধু সিনেমার নায়কদের নায়ক বলি, অথচ বাস্তবের এই মানুষগুলোকে জানিও না ঠিকঠাক করে? অরুণাভের কাহিনী যেন সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়—একজন শিক্ষকও যদি ইচ্ছাশক্তি নিয়ে এগিয়ে আসে, তবে তিনিও হয়ে উঠতে পারেন এক সাহসী সেনানায়ক। তাঁর এই যাত্রা শুধু প্রেরণা নয়, আমাদের সমাজে পেশা পরিবর্তনের বিষয়ে একটি ইতিবাচক বার্তা দেয়—নিজের স্বপ্ন আর দায়িত্ববোধ মিলে গেলে জীবনের যেকোনো পর্যায়ে নতুন অধ্যায় শুরু করা সম্ভব। আগামীতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শান্তিরক্ষা মিশনে অরুণাভের মত সেনাদের যুক্ত করা হতে পারে বলে সূত্রের খবর। ভারতও এই মিশনে ভবিষ্যতে আরও বেশি সংখ্যক দক্ষ, প্রশিক্ষিত এবং মানবিক সেনা প্রেরণের পরিকল্পনা করছে। সব মিলিয়ে নদিয়ার ছেলেটির এই সাফল্য আমাদের শেখায়, শিক্ষকতা হোক বা সেনাবাহিনী—যেখানে মন দিয়ে কাজ করলে, সেখানে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিজেই এসে কুর্নিশ জানাতে বাধ্য।