Night marathon race in Khatra, Bankura:-বাঁকুড়া জেলার খাতড়া শহর যেন শনিবার রাতে আলাদা প্রাণ ফিরে পেল — কারণ সেই রাতে শুধু বাতাসে দৌড়ানোর শব্দ ছিল না, ছিল উৎসবের আমেজ, সমাজ সচেতনতায় ভরা এক মহান উদ্যোগ, আর মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা এক চিরস্মরণীয় অধ্যায়, যার নাম “খাতড়ার নাইট ম্যারাথন ২০২৫”। খাতড়া হেল্পিং হ্যান্ডস নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত এই নাইট ম্যারাথন বাঁকুড়া জেলার প্রথম রাত জেগে হওয়া দৌড় প্রতিযোগিতা। এতদিন পর্যন্ত দৌড় প্রতিযোগিতা মানেই সকালের আলো, পাখির ডাকা আর ঠান্ডা হাওয়া। কিন্তু খাতড়া দেখাল, যে দৌড় কেবল সূর্যোদয়ে নয়, চাঁদের আলোতেও হতে পারে গর্বের, অনুপ্রেরণার এবং সুস্থ সমাজ গঠনের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। রাতে খাতড়া শহর যেন এক অন্যরকম উৎসবে মেতেছিল — পাম্প মোড়, দেদুয়া ব্রিজ, মুকুটমণিপুরের রাস্তা, সব যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল এক অন্য আলোয়। ছেলেদের দৌড় শুরু হয় দেদুয়া ব্রিজ মোড় থেকে, ১৪ কিমি পেরিয়ে পৌঁছায় মুকুটমণিপুর, সেখান থেকে আবার দৌড়ে ফিরে আসে দেদুয়া ব্রিজে। আর মেয়েদের দৌড় শুরু হয় মুকুটমণিপুর থেকে, শেষ হয় দেদুয়া ব্রিজ মোড়ে, যা ছিল ৭ কিমি পথ। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন খাতড়া, ছাতনা, কমলপুর, ঝাড়গ্রামসহ বিভিন্ন জায়গার দৌড়প্রেমী তরুণ-তরুণীরা। এই প্রতিযোগিতায় ছেলেদের বিভাগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেন যথাক্রমে তারক মাণ্ডি, প্রশান্ত দাস, এবং উজ্জল মাণ্ডি।

মেয়েদের বিভাগে প্রথম হন সুতপা মুখার্জি, দ্বিতীয় স্মৃতি মুর্মু ও তৃতীয় স্থান অর্জন করেন অর্পিতা টুডু। প্রত্যেক বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় নগদ অর্থ ও সুদৃশ্য ট্রফি, যা একদিকে যেমন তাঁদের পরিশ্রমের স্বীকৃতি, তেমনই ভবিষ্যতের জন্য এক বড়ো অনুপ্রেরণা। প্রতিযোগিতা শেষে খাতড়ার পাম্প মোড়ে অনুষ্ঠিত হয় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, যেখানে উপস্থিত ছিলেন সমাজকর্মী সুব্রত দে, হেল্পিং হ্যান্ডস-এর বিভিন্ন সদস্য, স্থানীয় মানুষজন এবং উচ্ছ্বসিত দর্শকরা। অনুষ্ঠানে সুব্রত দে বলেন, “এই দৌড় শুধুই একটি খেলা নয়, এই দৌড় সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ, স্বাস্থ্য সচেতনতা আর পরিবেশ সম্পর্কে ভাবনার প্রতীক।” হেল্পিং হ্যান্ডস সংগঠনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, এই নাইট ম্যারাথন আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজের মধ্যে সবুজায়ন, স্বাস্থ্য সচেতনতা, ও সামাজিক দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা। সংগঠনটি তাদের অন্যান্য সামাজিক উদ্যোগের কথাও জানায় — যেমন রক্তদান শিবির, উৎসব বা পারিবারিক অনুষ্ঠানের পর অতিরিক্ত খাবার সংগ্রহ করে পথবাসীদের মধ্যে বিতরণ, স্কুলে পড়াশোনার সামগ্রী বিতরণ এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি।
হেল্পিং হ্যান্ডসের অন্যতম সংগঠক রাহুল মাহাতো বলেন, “আমরা চাই এই প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র একটি খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, একটা বার্তা দিক — যে খাতড়া শুধু মেলার শহর নয়, আমরা সব দিক থেকে এগোতে চাই।” অংশগ্রহণকারী এক কিশোরী প্রতিযোগী দিপালী হেমব্রম বলেন, “এতো রাতে দৌড়ানোর অভিজ্ঞতা এই প্রথম, কিন্তু ভয় না পেয়ে সবাই পাশে ছিল, উৎসাহ দিয়েছে, মনে হয়েছে পুরো শহর আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।” আরেক প্রতিযোগী রজত বাউরি বলেন, “এই দৌড় আমাকে শুধু পুরস্কার নয়, আত্মবিশ্বাসও দিয়েছে।” সুরক্ষার দিকেও ছিল বিশেষ নজর।

খাতড়া থানার পুলিশের সহায়তায় প্রতিটি রুটে রাখা হয়েছিল পর্যাপ্ত আলো, জল ও চিকিৎসা সহায়তা। স্বেচ্ছাসেবী সদস্যরা সারারাত জেগে প্রতিটি মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিযোগীদের সাহায্য করেছেন। শহরের অনেক মানুষ খাটিয়া, চেয়ার নিয়ে রাস্তায় বসে থাকেন শুধু দৌড়কারীদের উৎসাহ দিতে। এক প্রবীণ নাগরিক বলেন, “এই রকম সন্ধ্যা তো আগে দেখিনি! পুরো শহর যেন এক হয়ে গেল।” এই নাইট ম্যারাথন শুধু একটি দৌড় প্রতিযোগিতা ছিল না, এটি ছিল শহরের মানুষকে এক সুতোয় গাঁথার এক মেলবন্ধন। ছোট শহরেও বড় চিন্তা, তা আবারও প্রমাণ করল খাতড়ার এই আয়োজন। শহরের ছেলে-মেয়েরা যেমন নিজেদের প্রমাণের সুযোগ পেল, তেমনই সমাজে সচেতনতার আলো ছড়াল এই পদক্ষেপ। ভবিষ্যতে এই আয়োজন আরও বড়ো আকারে করার পরিকল্পনা আছে বলে জানিয়েছে হেল্পিং হ্যান্ডস। তাঁরা চায়, রাজ্যের অন্যান্য জেলাও দেখুক খাতড়া কীভাবে রাতের আঁধারে আলো জ্বেলে ছুটে চলেছে উন্নয়নের দিকে। এই প্রতিযোগিতা প্রমাণ করল — খেলা শুধু মাঠে হয় না, রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দৌড়েও সমাজ বদলাতে পারে। এই একসাথে দৌড়, ঘাম, আনন্দ, উৎসাহ, আর চেতনায় ভরা সন্ধ্যা বাঁকুড়ার মানুষের মনে বহুদিন থেকে যাবে। খাতড়ার মানুষ আজ গর্ব করে বলতে পারেন, আমরা শুধু ইতিহাস নয়, ভবিষ্যৎও তৈরি করছি — দৌড়ে, সাহসে আর সামাজিকতার মাটিতে দাঁড়িয়ে।