All Bengal Teachers’ Association’s SSC building drive: যেদিন শিক্ষার মন্দিরে নিয়োগের নামে অবিচারের কাঁটা গাঁথা হয়, সেদিনই জন্ম নেয় প্রতিবাদের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। আর ঠিক এমনই একটি ছবি দেখা গেল রাজ্যের শিক্ষক সমাজের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে, যেখানে নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতি তাদের বহুদিনের ক্ষোভ, হতাশা আর হতবাক করে দেওয়া ন্যায়ের দাবি নিয়ে এসএসসি ভবনের সামনে এক জোরালো বার্তা দিলেন — “যোগ্যদের চাকরি ফেরত চাই!” দিনটি ছিল একেবারে সাধারণ দিনের মতোই, কিন্তু করুণাময়ী থেকে যখন নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির মিছিল শুরু হয়, তখনই বোঝা যায় — এটা নিছক মিছিল নয়, এটা একটা আন্দোলনের আওয়াজ। শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বহু চাকরি প্রার্থীর এখনো কাজ জোটেনি, অনেকেই অবৈধভাবে বাদ পড়েছেন, আবার অনেকের নাম তালিকায় আসেনি ঠিক সময়ে। এসএসসি-র দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যেমন হয়েছে, তেমনি এই মিছিলে দাবি ছিল — যারা প্রকৃতপক্ষে যোগ্য, তাদের দ্রুত পুনর্বহাল করা হোক, যেন রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে না পড়ে। কারণ যোগ্য শিক্ষকের অভাবে ক্লাসরুম ফাঁকা থাকছে, আর তার ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামের, প্রান্তিক এলাকার শিশুরা।এসএসসি ভবনের সামনে পৌঁছানোর আগেই পুলিশ ব্যারিকেডে মিছিল আটকে যায়। তাতেই ক্ষোভ আরও বেড়ে যায় শিক্ষক আন্দোলনকারীদের মধ্যে। তখন রাস্তাতেই বসে পড়ে তারা, শুরু হয় অবস্থান বিক্ষোভ। কারও হাতে প্ল্যাকার্ড, কারও গলায় স্লোগান — “যোগ্যদের হকের চাকরি ফিরিয়ে দাও”, “অযোগ্যদের নাম প্রকাশ করো”, “শিক্ষার অপমান চলবে না”। কিছুক্ষণ বিক্ষোভ চলার পর প্রশাসনের তরফে আশ্বাস আসে যে, একটি প্রতিনিধি দল ভবনে প্রবেশ করতে পারবে। নির্বাচিত দশজন প্রতিনিধি এরপর ভবনের ভিতরে গিয়ে এসএসসি-র আধিকারিকদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় বৈঠক করেন।
বৈঠকের পর বেরিয়ে এসে নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির অন্যতম মুখ মীনাক্ষী গোস্বামী বলেন, “আমরা বারবার বলেছি, যাদের নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে, তাদের নাম প্রকাশ করলেই আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। মাত্র ১২০০ থেকে ১৮০০টি কপি প্রিন্ট করলেই এই সমস্যার সুরাহা হয়ে যেত। তাহলে আজ রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার এত বড় ক্ষতি হতো না।” তাঁর এই বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার, আন্দোলনের মূল লক্ষ্য প্রতিহিংসা নয়, বরং সত্যকে সামনে আনা এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা।এই বিক্ষোভে অংশ নেওয়া আরেক শিক্ষক আন্দোলনকারী, মৃণাল বর্মণ জানান, “আমি ২০১৬ সালের টেট পাস করেছিলাম, ইন্টারভিউয়েও ভালো ফল করেছিলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো চাকরির খবর পাইনি। অথচ শুনি, অনেক অযোগ্য লোক চাকরি পেয়েছেন, যাদের নাম খুঁজে পাওয়াই যায় না পরীক্ষার তালিকায়।” মৃণালের মতো আরও বহু তরুণ-তরুণী এদিন এই মিছিলে এসে নিজের দুঃখের কাহিনি শোনান, যেটা কেবল চাকরি না পাওয়ার বেদনা নয়, বরং একটা সিস্টেমের প্রতি হারানো আস্থা, একটা বিশ্বাসভঙ্গের কষ্ট।এখানে একবার একটু ফিরে তাকানো যাক এসএসসি ভবন ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার দিকেও। পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC) মূলত রাজ্যের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের কাজ দেখে। কিন্তু গত কয়েক বছরে নানা দুর্নীতির অভিযোগ এই প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে। নিয়োগ পরীক্ষায় অস্বচ্ছতা, নামের তালিকায় গড়মিল, টাকা নিয়ে নিয়োগ—এসব অভিযোগ রাজ্য রাজনীতিকে রীতিমতো উত্তাল করেছে। বিচারব্যবস্থা পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করেছে এই প্রক্রিয়ায়। এখনো পর্যন্ত বহু প্রার্থী অপেক্ষায় আছেন ন্যায়ের আশায়, অনেকেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
এসএসসি দপ্তর যদিও বলেছে, তারা সব কিছু বিচার করে, তদন্ত করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টায় আছে। কিন্তু বাস্তবের চিত্র বলছে অন্য কথা। প্রতি বছর শিক্ষক স্বল্পতায় স্কুলে ক্লাস হয় না ঠিকমতো, গ্রামে পড়ুয়ারা পড়াশোনায় আগ্রহ হারাচ্ছে। অথচ যারা চাকরির জন্য অপেক্ষায় আছেন, তারা হাহাকার করছেন দিনের পর দিন।এই অবস্থায় নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির এই অভিযান নিছক রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, বরং এটি এক বৃহৎ সামাজিক দাবি, যেখানে শিক্ষা, ন্যায়, স্বচ্ছতা আর প্রাপ্যতার প্রশ্ন জড়িয়ে। ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বোঝা যাচ্ছে, যদি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় আরেকটা বড় সংকট দেখা দিতে পারে। যেহেতু শিক্ষক না থাকলে ছাত্ররা বিপদে পড়ে, আর ছাত্র বিপদে পড়লে আগামী সমাজ বিপন্ন হয়।প্রশাসনের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্যদের নিয়োগ সম্পন্ন করা এবং অযোগ্যদের নাম সামনে এনে সাধারণের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। নচেৎ এরকম আন্দোলন আরও বাড়বে, আরও তীব্র হবে এবং শিক্ষার প্রতি মানুষের যে আস্থা তা চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।আন্দোলনের পরের দিন, শহরের বিভিন্ন জায়গায় এই খবর ছড়িয়ে পড়ে, সাধারণ মানুষও শিক্ষকদের পাশে দাঁড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে থাকেন—“যোগ্যরা চাকরি পাক, অন্যায় রোখা হোক।” এই একাত্মতাই দেখায় যে, শিক্ষকদের দাবি নিছক নিজের জন্য নয়, এটা গোটা সমাজের জন্য, নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যতের জন্য।শেষে এটুকুই বলা যায়, এসএসসি ভবন অভিযান ছিল না শুধুই একটি প্রতিবাদ, এটি ছিল একজন সাধারণ শিক্ষক, একজন পরীক্ষার্থী, একজন মা-বাবা ও একজন ছাত্রের সম্মিলিত চিৎকার — “ন্যায় চাই, প্রাপ্য চাই, আর কিছু নয়।”